যখন থেকে গাড়ি চালানো শিখতে শুরু করেছিলাম, তখন থেকেই মনের কোনে দানা বাঁধতে শুুরু করেছিল উড়ে বেড়ানোর; বড়ই ভালোবেসে ফেলেছিলাম ড্রাইভিংটাকে। কালক্রমে ড্রাইভিংএ হাত পাকানোর সাথে সাথে এটা সেটা ট্রিপও সেরে ফেললাম রাজ্যের চৌহদ্দির মধ্যে, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া এটা সেটা, সবই আমার ছোট আলটোয়। তার সাথে একটা সুপ্ত বাসনাও মনের মনিকোঠায় ক্রমশই দানা বাঁধতে শুরু করে, একটা বড় ট্রিপ করার। গাড়িতে, নিজে ড্রাইভিং করে, রোড ট্রিপ! ইউটিউবের বিভিন্ন ভিডিও থেকে মনের সেই সুপ্ত ইচ্ছার শুধু রসদ সংগ্রহই হতে থাকে, কবে নিজেরও একটা ট্রিপ হবে, রীতিমত রোড ট্রিপ।
ওপরের জনের ইচ্ছায় সেই শখও মেটানোর সুযোগ মিলেই গেল বলা চলে, যখন আমার নেক্সট বড় গাড়ি কিনলাম। (বড় বলতে আবার সেরম বড়ও কিছু নয় যে ঢাঁক পেটানোর মত) কিন্তু একটু বড় আমার আগের আলটোর থেকে।
যাই হোক, সেই বহু জমিয়ে রাখা শখটা মেটাবার সুযোগ এসেই গেল। আট মাস আগে ছুটির আবেদনও করে দিলাম, আর তারপর খোঁজাখুঁজি – হোটেল বুকিং, রুট ম্যাপ ঠিক করাবার মত ইত্যাদি এক্সসাইটিং পক্রিয়ার শুরু।
শুরুতে ঠিক ছিল পাড়ি জমাব সুদূর দক্ষিন তটে অবস্থিত রামেশ্বরম পর্য্যন্ত। যদিও সময়ান্তে সেটা যে একটু বেশী উচ্চভিলাসী ইচ্ছা হয়ে যাচ্ছে সেটা আমরা বুঝেছিলাম। সময়, দূরত্ব সবই তার মধ্যে সামিল ছিল। অনেকেই যাঁরা লম্বা সফরের রোগী, তাঁরাও পরামর্শ দিলেন সময়ের অনুপাতে একটু বেশিই (যদিও অসম্ভব নয়)। তবে হ্যাঁ, ভ্রমনের স্বাদ নিতে একটু থামারও প্রয়োজন।
দু’সপ্তাহের ছুটি, যাত্রী তিন জন – আমি, স্ত্রী এবং আমাদের বছর চারের পুত্র সন্তান। অবশেষে নানান মতামত, পরামর্শ এবং সময় ও সুযোগের ভিত্তিতে ঠিক হল চেন্নাই পর্য্যন্ত যাবার, এবারের মত। একটা রাউন্ড ট্রিপ – কোলকাতা to চেন্নাই to কোলকাতা। চারটে বড় রাজ্য, মাঝখানে ছোটবড় অগুনতি শহর, মনের আলহাদ বাঁধ মানছিল না যখন পুরো রুট প্লানের ম্যাপিং শেষ হল। অতঃপর ঠিক হল এই ভাবে :
১ম দিন: যাত্রা শুরু: কোলকাতা to ভুবনেশ্বর
২য় দিন: ভুবনেশ্বর to ভাইজা্ক
৩য় দিন: ভাইজা্ক শহর পরিক্রমা
৪থ দিন: ভাইজা্ক to ভিজয়ওড়া
৫ম দিন: ভিজয়ওড়া to চেন্নাই
৬ঠ দিন: চেন্নাই শহর পরিক্রমা ১
৭ম দিন: চেন্নাই শহর পরিক্রমা ২
৮ম দিন: ফেরা: চেন্নাই to ভিজয়ওড়া
৯ম দিন: ভিজয়ওড়া to ভাইজা্ক
১০ম দিন: ভাইজা্ক to আরাকু (এবং পরিক্রমা)
১১ম দিন: আরাকু to শ্রীকাকুলম
১২ম দিন: শ্রীকাকুলম to পুরি
১৩ম দিন: বিশ্রাম (কলহপ্রবন জীবনে ফেরার আগে একদিনের কাঙ্খিত থামা)
১৪ম দিন: পুরি to কোলকাতা

আর এর পরে শুধু অপেক্ষা করা। এপ্রিলের মধ্যেই মোটামুটি মূল কাজগুলি সারা হয়ে গেছিল, যেমন হোটেল বুকিং ইত্যাদি। হাতে এখনও চারটি মাস। যে যাই বলে কান বন্ধ করে মুখে হাসি রেখে মাথা গুঁজে কাজ করে যাও, শুধু সেই দিনটার অপেক্ষায়; আর তারপর আমিও লবডঙ্কা দেখিয়ে কাটব।
অতঃপর সময়ের নিয়মে যাত্রার সপ্তাহও এসে গেল। ধীরে ধীরে বাক্স-প্যাঁটরাও সেজে উঠতে থাকল। যাত্রার আর তিন দিন বাকি।
দিনটা ছিল ১৬ই আগস্ট, ২০১৯, শুক্রবার। হাতে মোটে আর একটা দিন। বর্ষার সময়, কিন্তু সেই সপ্তাহে বর্ষার সেরম একটা প্রকোপ ছিল না। সকাল থেকেই আকাশের মুখ একটু ভার ছিল তবে ঘুনাক্ষারেও বোঝা যাচ্ছিল না কি আসতে চলেছে।
দুপুর তিনটের সময়ে আকাশ ঘনিয়ে এল কালো মেঘ। মেঘের ভিতরে বিদ্যুতের মুহুর্মুহূ ঝলকানি দেখে মনে হচ্ছিল কিছু হতে চলেছে। মুশলধারে বৃষ্টি নামল এর পর, আর সেই যে শুরু হল পরের দিন সকালের আগে থামার নাম নিল না। সময়ে বেগ কিছুটা হালকা হলেও ক্রমাগত ঝরেই যাচ্ছিল। এত বৃষ্টির পর যা হবার আশঙ্কা থাকে, আমাদের উঠোনে থইথই করতে লাগল হাঁটু ডোবা জল। বাড়ির দোরগোড়া থেকে জলের রাশি যতদূর অব্দি রাস্তার বাঁক দেখা যায়। আমাদের কারোরই বুঝতে বাকি রইল না একটা অঘটন ঘটে গেছে, আমাদের যাত্রার নিরীখে।
বাইরে বেরিয়ে এসে যখন থই থই বাস রাস্তায় হাঁটু ডোবা জলে দাঁড়িয়ে আছি, তখন হয়ত বুকের মধ্যে দুমড়ে মুচড়েও উঠেছে এক বাঁধ ভাঙ্গা কান্না, স্বপ্নগুলোকে ডুবতে দেখছিলাম। বৃষ্টি ‘থামলেও’ ক্রমাগত ঝরা বর্ষনের মত ঝিরিঝিরি ঝরেই যাচ্ছিল। সারা কোলকাতা ভাসছিল, চারিদিকে শুধু ভেসে যাওয়ার ছবি উঠে আসছিল tvর পর্দায়। আবহবিদরা ভবিষ্যতবাণী করছিলেন আরো দুদিন এরম চলতে পারে। আমাদের সব আশা-ইচ্ছা খোলা আর অসমাপ্ত সুটকেসগুলোর মত ছড়িয়ে পড়ে রইল।
দুপুরের দিক থেকে বৃষ্টি একটু থামল। আকাশ চাপ মতন হয়ে রইল যদিও। প্রশাসনও যেন উঠে পড়ে লেগেছিল এই সময়টুকুর সদ্ব্যাবহারের জন্য, চারিদিকে বড় বড় জেনেরেটর চালিয়ে জল বের করার কাজ ক্রমাগত চলতেই থাকল, আর সবাই আকাশের দিকে চেয়ে ক্ষীন মনে একটাই প্রার্থনা করতে লাগলাম, আবার না আসে।
সে রাতে আর বৃষ্টি আসেনি। আকাশ ছিল শান্ত, চুপচাপ। দুয়েকটা তারাও হয়ত বেরিয়েছিল, কিন্তু এমন শান্ত নীরবতাও যেন মনে কোথাও ভয় ধরিয়ে দেয়। যাই হোক, আমরা সে রাত্রে ভালো করে ঘুমাতে পারিনি। মাঝে মধ্যেই ঘুম ভেঙ্গে বাইরে চেয়ে দেখেছি যে বৃষ্টি এল কিনা, আর মনে মনে চেয়েছি এভাবেই থাক, এভাবেই থাক। সে রাত্রে প্রকৃতি আমাদের প্রার্থনা রেখেছিল।
ভোররাত্রের আলো ফুটতেই বাইরে গিয়ে হাজির হই। বাস রাস্তা এখনো কোথাও কোথাও নিমজ্জমান তবে অনেকাংশে জল শুধু দু’পাশের ঢালগুলিতে এসে থেমেছে। আকাশের মুখ এখনো ভার, গুরি গুরি বৃষ্টির সাথে ঠান্ডা হাওয়াও চলছে।
আমরা দু’জনেই (আমার স্ত্রী এবং আমি) একমত হলাম যে হলে এখনি আর নাহলে নয়।
হিচড়ে গলির জল উপচে ফেলে আমাদের চারপেয়ে দানবকে বাইরে নিয়ে এলাম, বাড়ির অদূরেই বাস রাস্তায় পার্ক করা হল। এবার শুধু লাগেজ তোলার পালা, বৃষ্টি তখন নিরবিচ্ছিন্নতার আকার নিয়েছে, গুরি গুরি থেকে ঝিরিঝিরি বর্ষনে পরিনত হয়েছে।
এর পরের আধা ঘন্টা শুধু দম না ফেলে ছোটাছুটির পালা। অবিন্যস্ত হয়ে পড়ে থাকা সুটকেস/ব্যাগ (যা শেষ দু’দিনে গুছিয়ে উঠবার কথা ছিল) যেভাবে হোক গুছিয়ে, যতটুকু যেরম যা মনে পড়ে ব্যাগে ভরে গাড়িতে ওঠানোর পালা চলল। এর মধ্যে কতটা কি নেয়া হল বা নেয়া হলনা তা খতিয়ে দেখার সুযোগ রইল না, যতটুকু কম সময়ের মধ্যে রাস্তায় নেমে পড়া যায় সে চেষ্টাই চলল। তার মধ্যে এমন একটা জিনিষও ভুললাম যা আমাদের ট্রিপকে ভীষনভাবে প্রভাবিত করতে পারত। ঘরদোর অপেক্ষাকৃত আগোছাল অবস্থাতেই পড়ে রইল, স্যাঁতস্যাঁতে জিনিষপত্র এদিক ওদিকে ডাঁই করা, কোনরকমে সবাইকে গুছিয়ে নিয়ে মা’কে প্রনাম করে যখন গাড়ির সীটে উঠে এলাম সেমুহূর্তে হয়ত স্টীয়ারিংএ হাত দিয়ে হাতো কেঁপেছে.. বা আমি হয়ত একটু বেশিই কাব্যিক হয়ে পড়ছি এ মুহূর্তে।
ছিটিয়ে আসা জল গাড়ির উইন্ডস্ক্রীনে ধাক্কা মেরে যখন তারাতলামুখী ব্রীজে উঠে এলাম, তখন এক মিশ্রিত আনন্দ আর অবিশ্বাস কাজ করছে আমার মধ্যে। জেল থেকে ছাড়া পাওয়া কয়েদীদের সঙ্গে হয়ত আমি সে অনুভূতির তুলনা করতে পারি। এক মিশ্রিত রোমাঞ্চের ঢেউ আছড়ে পড়ছিল যখন দেখছিলাম আমার পাশের সীটে আমার পরিবার আর সামনে বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়া কালো পিচ রাস্তা, এক লম্বা সফর।
ওহ মা! আমি কোন কার্ড আনিনি সঙ্গে (debit/credit), উপলদ্ধিটা তখন হল যখন বাড়ি থেকে ৪/৫ কিমি এগিয়ে এসেছি। সম্বল খালি কিছু ক্যাশ দুজনের কাছে।
যাই হোক, সেযাত্রায় আমাদের আর পিছনে ফিরতে হয়নি। দেবদূতের মত শ্বশুর এসে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর একাধিক ক্রেডিট কার্ড আমাদের হাতে দিয়ে। না হলে সত্যি মুসকিল হত 🙂
এরপর আমাদের আর সেভাবে ‘ভাসন্ত’ কোলকাতার সামনা করতে হয়নি। মূল বাস রাস্তাগুলিতে জল সেভাবে ছিল না, আর কোনা এক্সপ্রেসওয়ে’ আশা স্বরূপ জল ছিলই না।
এবং, এভাবেই শুরু হল আমাদের বহু অপেক্ষাকৃত, রোড ট্রিপ!
তবে এবারে আর বেশি লেখায় নয়। অপরিপক্ক হাতে আমাদেরি তোলা কিছু চলমান ছবি এবং রাস্তার বিবরন রইল। এই এতটা পথ এত কিছু অভিজ্ঞতা, কত ছোট ছোট ঘটনা, খুব সহজে হয়ত তুলে আনতে পারব না, তবে চেষ্টা করব।
পৃথক দিনের হিসাবে একএকটি ভিডিও রইল, এবং সময়ের সাথে এই তালিকাও আপডেট হতে থাকবে, কথা রইল।
২য় দিনঃ ভুবনেশ্বর to ভাইজাক্
৩য় দিনঃ ভাইজাক্ ভ্রমন
৪থ দিনঃ বিজয়ওড়া থেকে চেন্নাই
ক্রমশঃ..