~ ২৩শে আগষ্ট ~
সত্যি বলতে এটা হয়ত ভুলই হয়েছিল যে আমি মানালি-লেহ্ রোড-ট্রিপ চয়েস করেছিলাম; এটা আকাশ পথেও হতে পারত। কিন্তু কোথাও সেই পরিচিত রাস্তাতে আবার ফেরার ইচ্ছা এবং সুস্মিতাকেও সেই রাস্তা দেখাতে চাওয়া – এ সিদ্ধান্তের পিছনে ছিল। বিতৃষ্ণাময় সত্য যে লাদাখ্ পৌঁছে ওখানেই দেখার জিনিষ এত আছে যে এই রোড-ট্রিপটাকে avoid করা যেতেই পারত। আমি দুঃখিত যে আমি এই রাস্তাকেই আবার বেছে নিয়েছি যখন গতবার শত অভিশাপে শাপিত করেছি এ রাস্তাকে এবং এ রাস্তায় আসার জন্য। এটাতো বটেই যে আমি ভুলে গেছিলাম সেই যন্ত্রনা-কষ্ট, আর এবারে যখন আমি আরো আন্ফিট।
ভোর ৩ঃ৪০ নাগাদ তৈরি হয়ে ব্যাগপত্র সমেত নিচে নেমে এলাম। ঠান্ডা খুব কন্কনে ছিল না, তাই পাকামি করে বার্মুডাই পরে রইলাম আর পায়ে স্যান্ডেল। বাইরের আলো তখনো সেভাবে ফোটেনি। রিসেপসনে এসে আমাদের ব্রেকফাস্ট প্যাক করে নিয়ে (যা প্যাকেজরই অন্তর্গত) এবার অপেক্ষা করা। দু’জনের কারোরই সেরম খাবার ইচ্ছা ছিল না। এর আগে রুম-টী দিয়ে আসা হয়েছিল।
বাইরে কিছুক্ষন অপেক্ষার পর লাগেজ লোড্ করা শুরু হল বাসের ডিগিতে। মোটামুটি সবাই বেশ ঠান্ডার জামাকাপড় পরিহিত। স্তব্ধ রাত্রির ঠান্ডার মধ্যেই লবির সামান্য আলোতে বাস বোঝাই শেষ হল, আমরাও যে যার পূর্ব-বরাদ্দ জায়গায় গিয়ে বসে পড়লাম আবার বাসের মধ্যে। ৪ঃ১০ নাগাদ বাস হোটেলের উঁচু ঢাল থেকে নেমে এল পাহাড়ি রাস্তায় এবং শুরু হল আমাদের দ্বিতীয় এবং শেষ দিনের যাত্রা, লেহ্’র উদ্দেশ্যে। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ, কেবল বাসের হেডলাইটের আলোয় অন্ধকার চিরে এগিয়ে চললাম আমরা। যাত্রীরা বাসের অন্ধকারের মধ্যে আরএক প্রস্ত ঘুমের সূচনা করল।
মাথা যন্ত্রনা একটা ছিল, কিছুক্ষনের মধ্যে এটাও অনুভব করলাম কি ভুল করেছি আমি। যদিও সব জানালা বন্ধ কিন্তু চলার সাথে ঠান্ডাও যেন ঢুকছে কোথা দিয়ে। গায়ে এটা-ওটা থাকায় সেরম অসুবিধা হচ্ছে না, কিন্তু নিম্নভাগের বার্মুডা-কেবল সত্যি অসুবিধায় ফেলেছে। মনে হচ্ছিল নিচ দিয়ে ঠান্ডা আসছে – কিন্তু নিশ্চিত ছিলাম না কোথা থেকে। ক্রমশঃ-ঠান্ডা কিছুক্ষনের মধ্যে বেশ কন্কনে ঠান্ডায় পরিনীত হল। বলাই বাহুল্য, বুঝতে বাকি ছিল না কি ভুল করেছি আমি। ঈর্ষা হচ্ছিল অন্যান্য সিটের দিকে তাকিয়ে কি সুন্দর ঘুমোচ্ছে সবাই – আর আমি —
পায়ের কন্কনানি এরমধ্যে এমন জায়গায় পৌঁচেছে যে কি করব কিছু বুঝে উঠতে পারছি না; জামা-প্যান্ট-জীনস্ ইত্যাদি যা আছে সব পোঁটলায়, আর পোঁটলা গাড়ির ডিগিতে। গিয়ে অনুরোধ করব অন্ধকার রাস্তায় গাড়ি থামাতে সে কানকাটা সাহসও পাচ্ছি না, কেবল নিজের মুণ্ডপাত করা ছাড়া। পা তুলে সিটের ওপর বাবু হয়ে বসে নিজের শরীরের যতটা কাছে ঢুকিয়ে নেয়া যেতে পারে, নিয়ে কোনরকমে ঠান্ডা থেকে বাঁচার চেষ্টা করেছি। সুস্মিতাও বুঝলাম খুব অসহায় বোধ করছে আমার এই অবস্থা দেখে, কিন্তু বেশী কিছু সাথেও নেই দু’জনের মধ্যে শেয়ার করার জন্য। ক্রমশঃ খারাপ হতে থাকে রাস্তাও এদিকে শরীরের আগাপাস্তালা ঢিলে করার কাজে নেমে পড়েছে।
ধীরে ধীরে আকাশের গায়ে দিনের আলোর ছোঁয়া দেখা দিল। কোন এক নাম-না-জানি জায়গায় এসে বাস থামল। ঠান্ডায় কাবু হয়ে যাওয়া পা’দুটোকে ছাড়ানোর জন্য নেমে পড়লাম, কিছু খাওয়ারও দরকার ছিল, ওখান থেকে যে খাবার প্যাক করে দিয়েছিল খুব একটা রোচক নয়। এক ধু-ধু ভ্যালির মধ্যে কোন এক নোমাডিক ল্যান্ডে এসে দাঁড়িয়েছি আমরা। যেখানে বাস থেমেছে, তার পাশে কিছু বড়-ছোট তাঁবু; তাঁবুর সাথেই বসতবাড়ি, দোকান-পাট, রেস্টুরেন্ট। তাঁবুর ভেতর যথেষ্ট উষ্ণ এবং আরামদায়ক। এরি মধ্যে একটা তাঁবুতে সাজিয়ে রাখা বিছানায় আয়েস করে বসে দু’টো ম্যাগির অর্ডার দেয়া হল। বাইরেতে বেশ কন্কনে ঠান্ডা।


এরমধ্যে একবার চেষ্টা করলাম গাড়ির খালাসীর সাথে কথা বলে কিছু জামাকাপড় বের করা যায় কিনা ডিগি থেকে। আমার আবদার শুনে ভদ্রলোক একটু বিরক্ত হলেন, উল্টে কিছু জ্ঞানও দিয়ে দিলেন। আমি কথা না বাড়িয়ে তিক্ত মুখে ফেরার পথ ধরলাম, দোষটা আমারি।
গরম গরম ম্যাগির পর আবার বাস চলতে শুরু করল। রাস্তার ক্রম-নিম্নমান অবস্থা আমার ওপর আবার ভারি হতে শুরু করেছে।
লাঞ্চের জন্য বাস কোথাও থামতেই আমি নেমে পড়লাম। শরীরের সমস্ত অস্বস্তি যেন নির্বিসহ করে তুলেছে এই যাত্রাকে। খাওয়া তো দূরের কথা, নোমাডিক হোটেলগুলোর পেছনে কোথাও গিয়ে বমি করে এলাম। আমার অবস্থা আন্দাজ করে হোটেলের মহিলা (যাঁর হোটেলে এসে নেতিয়ে বসেছি) রসুন-গরমজল দিলেন, “খেয়ে নিন, সিক্নেসে সাহায্য করবে।” সেটা গলায় ঢেলে, এককাপ চা আরো ঢেলে ধন্যবাদ দিয়ে গাড়িতে উঠে আসি। আবার সেই ক্লান্তিকর যাত্রার শুরু। নিয়মমত একটু একটু করে জল গলায় ঢেলে যাচ্ছি যাতে অক্সিজেনের অভাব না হয়।
এদিকে শরীরের অবস্থা খারাপ থেকে খারাপতর হচ্ছে বাসের ঝাঁকানির সাথে। রাস্তারও যেন শেষ নেই। দেখে ঈর্ষা বাড়তে লাগল অন্যান্যরা কেমন দিব্যি বসে আছে কিন্তু আমি! এর মধ্যে এটা একটা ভালো যে সুস্মিতা এখনও শক্ত আছে, যেখানে আমি ভাঙতে শুরু করেছি, ভেতর ভেতর। উল্টে আমাকে উজ্জিবীত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে একটানা, বুঝতে পারছি কতটা অসহায় বোধ করছে আমার এ অবস্থা দেখে।

বাসের ঝাঁকানি আর শরীরের অবস্থা একটা সময় এমন জায়গায় পৌঁছল যে বাসে আর বসে থাকা যাচ্ছিল না। দরজার দিকে তাকিয়ে নিজের আবেগগুলো কোনরকমে আটকাচ্ছি, কারন দরজা খুলে ঝাঁপ এমুহূর্তে সম্ভব নয়। দীর্ঘক্ষন ছোট জায়গায় বসে থাকার জন্যে সুস্মিতাও এবার পিঠের ব্যাথার সম্মুখীন হচ্ছে। পিছনের খালি সীটে খানিক্ষন পড়ে থাকার চেষ্টা করলাম, বাসের ঝাঁকানি সেটাও করতে দিল না। পিছনের সীটে এ যেন আরো কষ্টকর। এর সাথে মুষড়িয়ে দেয়া মাথা যন্ত্রনা সঙ্গ নিয়েছে, গা গুলিয়ে উঠছে। অবশেষে একটা প্যাকেটের মধ্যে সব উল্টিয়ে দিলাম।
অপ্রস্তুত লাগছিল, কিন্তু অনেকেই এগিয়ে এল কোনভাবে সাহায্য করার জন্য। সুস্মিতা যতটা সম্ভব আমাকে আগলে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে যাতে আমি একটু ভালো বোধ করি।
ক্রমশঃ
সম্পূর্ণ সিরিজ – এখানে