HPTDC ‘এর অফিসে পৌঁছে ভারী ব্যাগগুলো রেখে বেরিয়ে পড়লুম অদূরে রেস্টুরেন্টের উদ্দেশ্যে। পাহাড়ি রাস্তায় গাড়িতে ওঠার আগে একটু পেট ভরা থাকা ভালো।
দু’জনের জন্য স্যান্ডউইচ্ আর কোল্ড কফি অর্ডার করলাম। ও একটু uneasy ফীল করায় ওর খাবারটা প্যাক করে নেয়া হল, এদিকে বাস ছাড়ার সময়ও এগিয়ে এল।
আমরা রেস্টুরেন্ট ছেড়ে HPTDC ‘এর অফিসে পৌঁছতে ভদ্রলোক বললেন আপনারা তাড়াতাড়ি যান, বাস ছেড়ে দেবে তো! আবার মালপত্র নিয়ে মানালির রাস্তা ধরে ছুটলাম আমরা বাসস্ট্যান্ডের দিকে। হাতে ৫/১০ মিনিটের মত সময় ছিল। যাই হোক, মোটামুটি নির্ধারিত সময়ই বাস রওনা দিল, ১০ ‘টায়।
ছোটখাটো চার্টাড বাস যেগুলো পাহাড়ের বাঁকে আদর্শ। মানালির সবুজ পাদদেশ ধরে আমরা ক্রমশঃ এগিয়ে যেতে লাগলাম, আরো ওপরে। ছোটখাটো বসতি, দোকান-পাট, কোথাও কোথাও কঠিন রাস্তাঘাট ক্রমশঃ ফেলে আমাদের বাস এগিয়ে চলল।
আমরা বাঁদিকে বাসের ঠিক মাঝ বরাবর দু’টো সীট নিয়েছিলাম। সামনের দিকে সীট নিলে আরো ভালো হত, সেটা পরে বুঝেছিলাম। বাসে মোটামুটি অর্ধেকের বেশী ভিড় ছিল, তারমধ্যে আবার বেশীরভাগ যাত্রীই বিদেশী। দম্পতি, পরিবার, এমনকি অ্যাডভেঞ্চারাস মা এবং পুত্র। পিছনের কিছু সীট ফাঁকা।
বেশ কিছুটা দূরত্ব অন্তর বাস থামতে থামতে এগিয়ে চলল। থামা বলতে ক্ষনিকের ব্রেক – কোথাও টিফিনের জন্য, কোথাও প্রাকৃতিক দৃশ্য আহরনের জন্য (নিয়মমাফিক অথবা যাত্রীদের উৎপীড়নায়)। রোটাং পাশের পর থেকে প্রাকৃতিক সৌন্দয্যের আমূল পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল। মানালি থেকে অনেক উঁচুতে পাহাড়ের বর্ণ, বৈচিত্র, রূপ সেখানে আলাদা, পাহাড় এখানে আরো ছাল ছাড়ানো, মানালির মত সবুজে মোড়া নয়, পাহাড় এখানে আরো কর্কশ, কিন্তু কত বৈচিত্রে ঢাকা! বহুল texture, color সেইসব পাহাড়ের। কোথাও পাহাড় ঘন বাদামী, কোথাও গেরুয়া বা কোথাও ধূসর। মেঘ ভেসে চলেছে চূড়াগুলোর গা ছুঁয়ে। উজ্জ্বল দিনের আলোতে ভাসছে চারিদিক। ওপরে উন্মুক্ত নীল আকাশ, কোথাও বিন্দুমাত্র শ্লেষ নেই প্রকৃতির সৌন্দর্য্য উজাড় করে দেওয়াতে, আকাশ এখানে স্বচ্ছ, নিচের মত কুয়াশায় ঢাকা নয়। মুহুর্মুহু বাঁক, সোজা নেমে যাওয়া খাদ, খর্বকায় পাহাড়ের গা, সবমিলিয়ে ট্রাভেলার্সদের এক ঐকান্তিক অনুভূতি এবং অভিজ্ঞতা নিয়ে যাওয়া।


(এখানে বলে রাখি যাঁরা নাক সেঁটকান Nano সম্বন্ধে, মারহি (3360 mt.)-এরও আরো ওপরে দেখলাম একটা উঠে গেছে। দেখে মনে হল লোকাল, তার মানে প্রায়ই ওপর-নিচ করে। অর্থাৎ অতটাও যে হেলা করার মত ইঞ্জিন, তা হয়ত নয়।)
রাস্তার বৈচিত্রময় একঘেয়েমিয়তা, continuous বাঁক আর খারাপ রাস্তা ক্রমশঃ প্রভাব ফেলতে লাগল আমাদের ওপর, ঢুলুনি রূপ নিল। একটা সময় দু’জনেই খানিক্ষনের জন্য চলন্ত বাসে ঘুমিয়ে পড়লাম।

বিকেল চারটে নাগাদ আমরা কিলং এসে পৌঁছালাম। চকচকে্ রোদ তখনো চারিদিক উজ্জ্বল করে রেখেছে। মনে হল গতবারের থেকে এবার তাড়াতাড়িই এসেছে কিলং’এ। এবারে বেশ বিকেল বিকেল আলো থাকতে থাকতেই এসে গেছি আমরা। এবারেও আমরা উঠে আসলাম সেই হোটেল চন্দ্রভাগাতে, HPTDC ‘এর সঙ্গে বোধহয় ব্যাবসায়িক চুক্তি এদের।
মেন্ রাস্তা থেকে কিছুটা ওপরে এই চন্দ্রভাগা হোটেল। সিঁড়ি দিয়ে একটুখানি উঠলেই পাহাড়ের গায়ে বেশ কিছুটা জায়গা নিয়ে এই হোটেল। এরমধ্যে সামনের অংশটা অনেকটা খোলা জায়গা নিয়ে বেশ কিছু তাঁবু খাটানো। মোটা ক্যাম্বিস কাপড়ের তাঁবুগুলো মোটামুটি সারা সিজ্নটাই হয়ত খাটানো থাকে। যেসমস্ত ট্যুরিস্টরা পথিমধ্যে এখানে উঠে আসে তাঁরা এই তাঁবু ভাড়া নিতে পারেন অথবা মেন্ বিল্ডিং’য়ের রুমও নিতে পারেন। মেন্ বিল্ডিংটি দু’তিন তলার এবং তাঁবুগুলোর বাদেই তার অবস্থান। HPTDC ‘র যাত্রীদের এখানে শেয়ারিং’এ তাঁবুতে রাত কাটানো এবং ডিনারের ব্যবস্থা, যা বাসের টিকিটের মধ্যেই ধরা থাকে। তবে যাত্রীরা কেউ চাইলে আলাদা করে বিল্ডিং’য়ের রুমও ভাড়া নিতে পারেন। আমাদের দু’জনকে একটা আলাদা তাঁবু দেয়া হল, সারির শেষ প্রান্তে। ভেতরে দু’টো সিঙ্গল ফোল্ডিং খাট, আর টিমটিমে একটি বাতি।
যেহেতু দিনের আলো কমতে হাতে বেশকিছুটা আরো সময় ছিল, একটু বসে জিনিষপত্র তাঁবুতে রেখে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। গতবার একটু অন্ধকার হয়ে গেছিল এবং একা ছিলাম বলে সেভাবে চারিদিকটা আর বেশী ঘুরে দেখা হয়নি। এবারে দু’জনে বেরিয়ে মূল রাস্তা ধরে ডাঁয়ে এবং বাঁয়ে দুদিকেই একটু ঘুরে নিলাম। অনেক নিচে একটা পাহাড়ি লোকালিটি। দু’জনে অনেক চেষ্টা করেও সেখানে নামার সহজ পথটা খুঁজে পেলাম না। ঘুরপথে অতটা এনার্জি নষ্ট করে নামার ইচ্ছাটাও পাচ্ছিলাম না; নামাটা সহজ ওঠার থেকে।
কিছুক্ষন এদিক ওদিক ঘুরে এসে রাস্তার ধারে হোটেলের নিচু পাঁচিলে বসে দু’জনে গল্প করে বেশ কিছুটা সময় কেটে গেল। পড়ন্ত রোদের চড়া তেজও ওইরকম জায়গায় অনুভব করা যাচ্ছিল। আমি হোটেলের মধ্যে গিয়ে কিছু চিপস্ আর একটা বিয়ার নিয়ে এলাম। একটু হতাশ হলাম খুব একটা চিলড্ নয় দেখে, কিন্তু যা আছে সব ওরকমই। আদ্ধেকের মত খেয়ে আমি বোতলটা ফেলে দিলাম। এরপর দু’জনে স্ন্যাক্স খেতে খেতে আর গল্প করতে করতে পাহাড়ি সন্ধ্যে নেমে আসা দেখলাম।
কিছুক্ষনের মধ্যেই গাঢ় অন্ধকারে চারিদিকটা ঢেকে গেল। হোটেলের অংশের মধ্যে দু’একটা টিমটিমে আলো শুধু বাইরের অন্ধকারকে ভেদ করবার দুর্বার চেষ্টা করে যাচ্ছে। তাঁবুগুলোর মধ্যে একটা করে মিটমিটে আলো যা তার গা ভেদ করে বাইরে আসছিল না। কেবলমাত্র মেন্ বিল্ডিং’য়ের মধ্যেই যা একটু আলোর ব্যাবস্থা আছে। এখানেই রিসেপসন্, ডাইনিং রুম, বাথরুম ইত্যাদি ছিল।
ট্যুরিস্টরা বিভিন্ন ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে অন্ধকারের মধ্যে ইতিউতি বসে আছে। খোলা আকাশের নিচে শান্ত অন্ধকারের তৃপ্তি নিতে নিতে গল্প, সামান্য হিমেল বাতাস তাতে যেন আরো রসদের সঞ্চয় করে যাচ্ছে। নিচ দিয়ে চন্দ্রভাগা নদীর বয়ে যাবার শব্দ কানে আসছে।
দু’জনেই তাঁবুর টিমটিমে আলোতে কিছুক্ষন বসে থাকতে থাকতে যে যার বিছানায় গা ছেড়ে দিলাম। সারাদিনের ক্লান্তি কখন চোখের পাতা এক করে দিল, নিদ্রা গেলাম কিছুক্ষনের জন্য। ঘুম ভেঙ্গে গেল হঠাৎ কিরম একটা অস্বস্তির মধ্যে। তাঁবুর নিস্প্রভ আলোর মধ্যে দেখলাম সুস্মিতাও উঠে বসে পড়েছে। সারির শেষ দিকের তাঁবু যেহেতু এটা, এদিকটা আরো চুপচাপ, কারো পদশব্দ যেন কানে আসে না। বাইরেটা এমনিতেও একদম নিঃশব্দ, শুধু নদীর বয়ে চলার শব্দ কানে আসছে। বড় বিরক্তি লাগল, যেন তাঁবুর মধ্যে সময় থেমে গেছে সেখানে।
কোন কিছুর একটা আওয়াজ শুনে সুস্মিতার ঘুম ভেঙ্গে গেছে। কথা বলে বুঝলাম বেশ অস্বস্তি বোধ করছে ও। আমার বোঝানোতেও যে ওর মনে খুব একটা ছাপ পড়ছে না বুঝলাম। তাঁবুর মধ্যেকার নিস্প্রভ আলো আর জমাট বেঁধে থাকা অন্ধকারগুলো যেন চারিদিক থেকে চেপে বসছিল আমাদের ওপর। বেরোতে চাইছিলাম ওই থমকে থাকা পরিবেশ থেকে, বাইরে একটু খোলা হাওয়ায়। যদিও ওর অস্বস্তিটা সেভাবে কাটেনি, আমি জোর করে নিজেদের দু’জনকে ঠেলে বাইরে নিয়ে এলাম। বাইরেটা নিকষ কালো। তাঁবুর রাশিকে ফেলে আমরা এগিয়ে গেলাম মেন্ বিল্ডিং’য়ের দিকে, যেখানে যথেষ্ট আলো আছে।
রিসেপসনের সামনে খোলা জায়গায় গিয়ে খানিক্ষন বসার পর এবং একটু ধাতস্ত হতেও বুঝলাম সারা রাতটা ওই ছোট্ট অন্ধকার তাঁবুর মধ্যে কাটানো, ওর পক্ষে একটু চাপ হয়ে যেতে পারে। আর যাই হোক এবারে আমারো ওই সারির শেষ একলা হয়ে যাওয়া তাঁবুটা ঠিক ভালো লাগছিল না। একটা অদ্ভুদ না বলা অস্বস্তি হচ্ছিল। যাই হোক, আমার মনে হল এবারে একটা সিদ্ধান্ত নেবার দরকার আছে। সুস্মিতাকে মানিয়ে রিসেপসনে কথা বলে দু’তলায় একটা ঘর নিয়ে নিলাম রাতটুকুর জন্যে। ওপরের তলার একটা বড় ঘর, অ্যাটাচড্ বাথ, বড় বিছানা – অনন্ত রাতটা ভালো কাটবে আশা রাখতে পারি।
হোটেলের বয়ের সাথে মিলে তাঁবু থেকে আমাদের লাগেজ্গুলো সরানোর ব্যাবস্থা করা হল। নতুন রুমে যদিও অনেক আলো ছিল না, কিন্তু রুমের আরামদায়কতা সে কমিকে বেশী মনে হতে দিচ্ছিল না। গরম জল, নরম বিছানা, সারাদিনের ক্লান্তিকর যাত্রার পর আর কি চায় একজন যাত্রী..
ক্রমশঃ..