প্রথম লাদাখ্ সফর ২০১২ ‘এ। এরপর কেটে গেছে দুটো বছর, বয়ে গেছে বহু ঘটনার স্রোত। কিছু গুরুত্বপূর্ণ, কিছু জীবন পাল্টানোর মত – বিবাহিত হয়েছি, বাবা চলে গেছেন চিরদিনের জন্য.. আর এরমধ্যে হয়ে গেছে আমার দ্বিতীয় লাদাখ্ ভ্রমন। এবারে একা নয়, দোকা।
এই দ্বিতীয় ভ্রমন ২০১৪’এ। বিয়ের ঠিক দ্বিতীয় বছরে। বিয়ের পর বলা যায় এটাই আমাদের প্রথম বড় সফর। গতবারের মত এবারেও যাত্রার সময় ঠিক হয়েছিল আগষ্টের মাঝামাঝি এবং শেষ হয়েছিল সেপ্টেম্বরের শুরুতে। এবারের অনুভূতিগুলো না বললেও চলে যথেষ্ট আলাদা ছিল, যথেষ্ট স্বতন্ত্র। ফিরে আসার পরেও যার রেশ ছিল বহুদিন পর্য্যন্ত, আমাদের দুজ’নের মধ্যে।
তবে এবারে আর সেভাবে কিছু লেখা হয়ে ওঠেনি। একটা iPod ছিল বটে, যাতে আমাদের যাবতীয় যাত্রাপথ, দিনক্ষন ইত্যাদি উল্লেখ থাকত, মাঝেমধ্যে কিছু এটাসেটা বর্ণনাও, তবে সেভাবে ট্রাভেললগ্ বলে কিছু উল্লিখিত হয়ে ওঠেনি। কোন নোটবুকও ছিল না, বা কোন কিছু লেখার ইচ্ছাও ছিল না। এবারের পূর্ণ সময়টাই দিতে চেয়েছিলাম আমার অর্ধাঙ্গীনিকে, তার চোখ দিয়েই দেখতে চেয়েছিলাম এবারের লাদাখ্কে।
কিন্তু এত কিছু ঘটনা, অনুভব – কোথাও বর্ণনা করে না যাওয়াতে কিঞ্চিত অসহিষ্ণুও লাগছিল। কোথাও কোনদিন স্মৃতির অতলে হারিয়ে ফেলারও একটা ভয় ছিল।
অতঃপর সেই লাদাখ্ সফরের দীর্ঘ কয়েক মাস পরে এই ট্রাভেললগ্ লেখার সিদ্ধান্ত নিলাম, এবং ট্যারাবেকা হাতের লেখাকে ভর করে সমস্ত না-ভোলা মেমরিগুলোকে একত্র করার কাজ শুরু করলাম।
একটু ফিল্মি কায়দায় বলতে গেলে, আসুন আমাদের সঙ্গে চলুন সেই সময়ের পাতায় যেখানে adventure, uniqueness মিলে মিশে গেছে এবং এমন একটা জায়গা উঠে এসেছে যার নামেতেই সব – লাদাখ্।
আশা করব যাতে আগের বারের মত স্পষ্ট থাকতে পারি নিজের বর্ণনায়।
.
~ ২০শে আগষ্ট ~
ছুটিটা মিলল কিছুটা চাপের মধ্যেই। ৫/৬ মাস আগে ছুটির দরখাস্ত করেও নেবার মুখে এসে অনেক হুল খেয়ে তবেই মিলল। কর্পোরেট জীবনযাত্রা, কি বা আর করতে পারি। মোটামুটি দু’সপ্তাহের জন্য আপাততঃ সব অভিযোগ সিকেয় তুলে রাখার সিদ্ধান্ত নিলাম। গতবারের ছুটির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এবারের ছুটির দিনক্ষনও প্ল্যান করা হয়েছিল। শুধু এই যে গতবারের ছুটিটা ১৮ই আগষ্ট শুরু হয়েছিল, আর এবারেরটা ২০শে আর ৩রা সেপ্টেম্বর অব্দি।
যাওয়া আসার প্ল্যানেও গতবারের সঙ্গে সামঞ্জস্য ছিল – বলা যায় proven গতিপথই অবলম্বন করা। তবে এবারে যেহেতু সঙ্গে আর একজন ছিল, তাই লেহ্ তে থাকার বন্দোবস্তটা আগে থেকেই করে নি। তবে সেখানেও কিছু নতুনত্ব ছিল না – গতবার যে গেস্টহাউসে উঠেছিলাম, সেখানেই থাকার বন্দোবস্ত করে নি খুব বেশী খোঁজাখুঁজি না করে। একবার গিয়ে থাকার সুবিদার্থে চাচাজির সঙ্গে ভালো আদিখ্যেতা হয়ে গেছিল (চাচাজি, যিনি Skitpo‘র মালিক) এবং বিদ্যুৎ-তাড়িত-ডাকের মাধ্যমেও যোগাযোগ ছিল। এ্যাডভান্স বুকিংটা তাঁরই মাধ্যমে করে নি।
আগের বারের সাথে এবারের অনেক কিছুর মিল থাকলেও একটা বড় অমিল ছিল, তা হচ্ছে শারীরিক গঠন। বেশ কয়েক কিলো মেদ অর্জনের সাথে সাথে ছিল degraded physical fitness যেটাকে নিয়ে আমি একটু চিন্তিতই ছিলাম। কিন্তু তাবলে কি একটা ট্রিপ করব না!
অতঃপর বুধবার ২০শে আগষ্ট সঠিক সময়ে যাত্রা শুরু করলাম, গন্তব্য হাওড়া স্টেশন। বিকাল ৪ঃ৫৫’এ হাওড়া-দিল্লী রাজধানী এক্সপ্রেস। যেরম বলছিলাম গতবারের মত এবারেও যাত্রাপথ একই রাখা হয়েছিল, সুতরাংঃ
হাওড়া রাজধানী -> দিল্লী
দিল্লী HPTDC বাস -> মানালি
মানালি HPTDC বাস -> লেহ্
আর আসার পথেঃ
লেহ্ ফ্লাইট -> দিল্লী
দিল্লী রাজধানী -> ঘরের ছেলে ঘরে
ট্রেন ছাড়ার কিছুটা আগেই আমরা স্টেশন পৌঁছে গেলাম, বলা যায় ‘বেশ’ কিছুটা আগে – প্রায় ২ ঘন্টা। সঠিক সময়ে ট্রেন স্টেশন ছাড়ল। বাইরে অন্ধকার নামার সাথে সাথে গাড়ির ঢুলুনি আর কামরার মধ্যেকার একঘেয়েমি, যাত্রীরা যে যার চাদরে জায়গা নিতে শুরু করল। আরো একটু রাত হতে খেয়েদেয়ে বিছানাও নিল। আমরা দু’জনে অন্ধকারের মধ্যে বসে iPod’এ গান শুনতে শুনতে অনেক্ষন কাটিয়ে দিলাম। হাজার একঘেয়েমির মধ্যে একটাই প্রশান্তির নিশ্বাস যে আমার সঙ্গে আমার বন্ধু ছিল।
রাত্রিটা খুব ঠান্ডা; ঠান্ডাতে আমার সর্দি লেগে গেল।

.
~ ২১শে আগষ্ট ~
বেশ একটু অস্বস্তি আর আধা-ঘুমন্ত অবস্থায় রাত্রিটা কাটল। একফালি বিছানা আর শেষ রাত্রির A/C ‘র কামড় প্রতিবারেই আমাকে কাবু করে, যার এবারেও কোন পরিবর্তন ছিল না।
মেখে থাকা জড়তার মধ্যে কোনভাবে অনুভব করলাম wife ‘এর ডাক। মুখের ওপর থেকে ব্ল্যাঙ্কেটটা সরানোর পরে দেখলাম চারিদিক আলোয় ভরে গেছে। সকালের নরম কিন্তু জীবনদায়ী আলোয় পুরো কামরাটা হাসছে। আমি বিছানা ছাড়লাম।
এরপর দিন অগ্রসর হতে শুরু করল চা, ব্রেকফাস্টের মধ্যে দিয়ে। সহযাত্রীরা অনেকেই নিজেদের মধ্যে অভিযোগ বিনিময় করতে লাগলেন খাবারের ক্রম-নিম্নমান গুনমান সম্বন্ধে। তাঁরা খুব খোলাখুলিভাবেই বিরক্তি দেখাতে থাকলেন টিকিটের বৃদ্ধিত দাম আর খাবারের নিম্নমান নিয়ে। কোথাও মনের কোনাতে আমিও হয়ত তাঁদের কথাগুলোকে সমর্থন করে গেলাম।
অতঃপর দিল্লীতে ট্রেন পৌঁছাল ১০ঃ২০’তে, ২০ মিনিট লেটে। আমার শালামশাই এর মধ্যে অপেক্ষায় ছিলেন স্টেশন চত্বরে। পেশায় NGO এবং কর্মগুনে এখন দিল্লীর পাকাপোক্ত বাসিন্দা, দিনটা ওঁর কুটিরেই কাটানোর সিদ্ধান্ত এবং সন্ধ্যায় বাস ধরে মানালির উদ্দেশ্যে। একটা অটো ধরে পুরানো দিল্লীর ব্যাস্ত পথ ধরে সুপ্রশস্ত রাজপথে উঠে আসা, তারপর আবারো অলিগলির মধ্যে দিয়ে সুভাষ নগর এসে পৌঁছানো। এই সময়টায় দিল্লীর গরম অনুভব করার মত বটে।
দুপুরে একপ্রস্থ ভারি খাওয়া-দাওয়া সেরে একটা ছোট্ট আয়েসের ঘুমের পরে বিকালে বাসস্ট্যান্ডে এসে যখন পৌঁছালাম, তখন সন্ধ্যে ৬ঃ০০’টা। এবারের HPTDC বাসের বোর্ডিং গতবারের থেকে আলাদা ছিল, গতবারের ছিল রাজপথ এলাকায়, এবারে মান্ডি হাউস চকে্। যাইহোক, ৬ঃ৩০ নাগাদ দুগ্গা-দুগ্গা বলে রওয়ানা দিল আমাদের বাস।
রাতে কোন একটি সুসজ্জিত ধাবায় খাওয়া-দাওয়া সারা, এবং আবার নাম-না-জানা নগর-রাজ্য ফেলে নিকষ কালো রাজপথ ধরে ছোটা।
.
~ ২২শে আগষ্ট ~
বাস বেশ অনেকটা লেটে মানালি এসে পৌঁছাল, গতবারের সাথে যদি তুলনা করি। গতবার যেখানে বাস পৌঁচেছিল সকাল ৭ ‘টায়, এবারে তা পৌঁছাল ৯ ‘টায়। আলোকজ্জ্বল দিন, উজ্জ্বল রোদ পরিষ্কার আকাশ। ঠান্ডা খুব একটা লাগছিল না এবং ম্যাল রোডের ব্যাস্ততাও ছিল সাধারন।
আমাদের পৌঁছানোটা অবশ্য অতটা সুখকর ছিল না। বাসেতে ৮ ‘টার পর থেকেই আমার টেনশন শুরু হয়ে গেছিল। HPTDC ‘এর লেহ্গামী বাসের টিকিটে departure টাইম ছিল ৯ ‘টা, আর মানালি এখনো অনেকটা দূর। বেশ কিছুটা সময় অসহনীয়ভাবে বসে কাটানোর পর ড্রাইভারের কেবিনে গিয়ে জিজ্ঞাসাই করলাম আমরা কখন মানালি গিয়ে পৌঁছাব। কথাবার্তার মধ্যে ওঁনারা (ড্রাইভার এবং কেবিনে থাকা অন্যান্যরা) জানতে চাইলেন কোন বাস ধরার আছে ইত্যাদি। জানানোয় ওঁনারা বললেন লেহ্’র বাস ১০ঃ০০ টায় ছাড়বে। শুনে চমকিত হলাম কিন্তু বিশ্বাসও করে উঠতে পারছিলাম সেটা বলব না, বাস তখনও মানালিগামী পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ ধরে ছুটে চলেছে। মাঝে পড়ছে বিভিন্ন বসতি, বাজার, ছোটখাটো গাড়ির জ্যাম। আমার টেনশন বাড়তে থাকে। ড্রাইভার ভদ্রলোক বললেন চিন্তা করবেন না, এই বাস পৌঁছালে তবে ওই বাস ছাড়বে। আমি তাও ভরসা করতে পারছিলাম না “কিন্তু ওঁনাদের টিকিটে লেখা আছে departure at 9:00 AM! তো আমরা কি at least ন’টার মধ্যে পৌঁছাব?” উত্তর এলো “চেষ্টা তো করছি, আর না হলে ভাববেন না – ও’ও তো আমাদেরি বাস আমি ফোন করে বলে দেব ওরা ওয়েট করবে।”
কিছুটা আশ্বস্ত আর কিঞ্চিত অসহায়তার সাথেই আবার সিটে এসে বসলাম। Wife ‘ও আমার চিন্তাটা অনুভব করতে পারছিল, কিন্তু সে বোধহয় আরো অসহায়।
অতঃপর বাস কোনরকমে পাক্কা ৯ ‘টায় মানালির পরিচিত রাস্তার এসে ঢুকল। আমার ধড়ে প্রান এলো যে এখনো একটা সুযোগ হয়ত আছে সময়কে পাল্লা দেবার (এখানে বলে রাখি ড্রাইভারদার অভয়বাণী যে লেহ্র বাস ১০ঃ০০ টায় ছাড়বে তখনো তা আমার বিশ্বাসের বাইরে, আমি টিকিটের সময়টাকেই ফাইনাল বলে ধরে নিয়েছি)। বাস ধীরে ধীরে ম্যাল রোডের পাশে বাস টার্মিনাসের মধ্যে ঢুকল। ঝলমলে দিন এবং রোদের মাঝে দু’জনেই খুব ব্যাস্ততার সাথে নেমে পড়লাম বাস টার্মিনাসের ব্যাস্ত ঘিঞ্জি রাস্তাতে। কিছুক্ষন অপেক্ষার পর আমাদের লাগেজ ছাড়াতে পারলাম লাগেজ হোল্ডার থেকে। তখনও আমাদের সম্পূর্ন লাগেজ ছাড়েনি, কিন্তু আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না – আমি একটা দিনও আটকে পড়তে রাজী ছিলাম না মানালিতে, সম্পূর্ণ মাল খালাসের দায়িত্ব স্ত্রী কে দিয়ে এবং সেখানেই অপেক্ষা করতে বলে আমি ছুটলাম HPTDC ‘র অফিসের উদ্দেশ্যে, হাতে লেহ্’র টিকিট। রপোর্টিং, কত নম্বর বাস এবং তা বেরিয়ে গেছে কিনা, এইসবই তখন ছুটছিল আমার মাথার মধ্যে।
ম্যাল রোডের ব্যাস্ত পথ ধরে ছুটছি। গায়ের উইনচিটারও মানালির উষ্ণতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঘাম ছড়াচ্ছে। HPTDC ‘র অফিস বাস টার্মিনাস থেকে ৫ মিনিটের পথ, মানালি ন্যাশনাল পার্কের কাছাকাছি। ভারি নিশ্বাসে কিছুটা উঁচু পথে ছুটে যখন HPTDC ‘র অফিসে গিয়ে ঢুকলাম, তখন দাঁড়িয়ে ভালো করে কথাও বলতে পারছিলাম না। হাফরের মত শ্বাস পড়া দেখে ডেস্কের ভদ্রলোক চেয়ার দেখিয়ে বললেন আগে বসুন, তারপর কথা বলবেন। অফিসের করিডরটা তখন বেশ ফাঁকাই ছিল। বাইরের গোল টেবিলগুলোর কিছুতে বিদেশী পর্য্যটকেরা বসে গল্প করছিল, বই পড়ছিল। পরিবেশ বেশ শান্ত।
ডেস্কের ভদ্রলোক আমাদের টিকিট দেখে বললেন আপনাদের বাস এক নম্বরে আর ৯ঃ৪০ ‘এর মধ্যে রিপোর্টিং, আর ১০ঃ০০ ‘এ বাস ছাড়বে। আমার তখন তা শুনে কি অবস্থা হল ভাষায় বর্ণনা করতে পারব না। এক অদ্ভুত পরিশ্রান্তি যেন ছড়িয়ে পড়ল আমার সারা শরীরে, থিতিয়ে পড়লাম একটু আরো চেয়ারে। একটু সময় নিয়ে বললাম “কিন্তু আপনাদের টিকিটে যে লেখা আছে ন’টা ডিপারচার টাইম, আমি তাই ছুটে ছুটে এলাম!” – “না। ওটা ভুল। বাস দশটাতে ছাড়বে আর ন’টা ৪৫এ রিপোর্টিং টাইম, সময়মত পৌঁছে যাবেন কিন্তু!” যেন এক ভারি বোঝা হালকা হয়ে ধীরে পায়ে বেরিয়ে এলাম অফিস থেকে।
এরপর বাসস্ট্যান্ডে যখন পৌঁছালাম আমার জন্য একরাশ উদ্বিগ্নতা নিয়ে অপেক্ষা করছিল Wife। ব্যাগপত্রের ভার ভাগ করে নিলাম। হাতে সময় ছিল মোটামুটি আরো ৪৫ মিনিট। কিছু টিফিন করার উদ্দেশ্যে আবার HPTDC ‘র অফিসের দিকেই হাঁটতে শুরু করলাম আমরা, সন্ধান কোন রেস্টুরেন্টের। অতিরিক্ত লাগেজ বলতে সেরম কিছু ছিল না, পিঠে একটা রুকস্যাক যাতে আমার জিনিষপত্র আর Wife ‘এর একটা ট্রলি সুটকেস্ যেটা আমিই টেনে নিয়ে চললাম; কিছু খুচরো ব্যাগ যেগুলো ও নিয়েছিল, উইনচিটারটা খুলে আমার কোমরে বেঁধে নিয়ে নিয়েছিলাম – খুব শিগগিরি আর ওটার প্রয়োজন দেখছিলাম না।
ক্রমশঃ..