ভাবছি কোথা থেকে শুরু করব.. ভালো, না খারাপ। প্রাপ্তি না আক্ষেপ। পাওয়া না দিয়ে আসা।
যদি ভাগ করি,
আক্ষেপঃ
– ঘন বসতিপূর্ন এবং রিমোট অঞ্চলে গুগল ম্যাপের খুবি বাজে নেভিগেশন
– ট্রাফিক পুলিশের কোঁতকানি
– WBSFDA ‘র পরিচালনহীন (এবং কিছুটা গাঁটকিলে) বিহারিনাথ রিসর্ট
প্রাপ্তিঃ
– অফ্-রোডিং!!
– কিছু কখনো না নেয়া রোড এক্সপেরিয়েন্স
– অপূর্ব বরন্তি ড্যামের পাশে এক রাত্রি কাটানো
– মুরাডি ইকো ট্যুরিস্ম
অগত্যা শুরু করি আমার কাহিনী।
২৬-এ জানুয়ারী রিপাব্লিক ডে’তেই যাওয়ার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু বুকিং না পাওয়ার দরুন সেটা পিছিয়ে পরবর্তী সপ্তাহে নির্ধারিত হয়। ভোরের আলো না ফোটার সাথে সাথেই কোন একদিন আমরা বেরিয়ে পড়লাম বাবা বাঁকে বিহারীর উদ্দেশ্যে। ভোর ৫ টা নাগাদ বাড়ি থেকে প্রস্থান এবং মোটামুটি ৬ টা নাগাদ AH45 এ।
ডানকুনি পর্য্যন্ত ওয়েদার মোটামুটি পরিষ্কারই ছিল, কিন্তু তারপরই কোথা থেকে একরাশ কুয়াশা এসে হাইওয়ে ঘিরে ধরল। কোথাও কোথাও কুয়াশা এতটাই ঘন ছিল যে দশ হাত দূরে পর্য্যন্ত ঠাহর হচ্ছিল না। যাইহোক, হ্যাজার্ড লাইট জ্বালিয়ে আস্তে-সিস্টে একের পর এক টোলগুলো পেরিয়ে একসময় শক্তিগড় গিয়ে পৌঁছালাম।
এরপর কোন এক চমচম হাউসে তেল পোড়া কচুরি খেয়ে মন খুব দুঃখিত হলেও আসানসোল বার্নপুরের রাস্তায় পড়ার পর থেকে মনটা বেশ উৎফুল্ল হয়ে গেল। আহা, কি রাস্তা। খাসা! এমন রাস্তা কেন সবজায়গায় হয় না।
যাইহোক, এরপর থেকেই গেরো শুরু হল। শুরু হল বার্নপুরের হাইওয়ে ছেড়ে লোকালিটির মধ্যে ঢোকার মুহূর্ত থেকেই। গুগল বাবাজি দেখাচ্ছিলেন সামনে আরো একটু গিয়ে বাঁয়ে বাঁক। অতি বিশ্বাসী হওয়ার দরুন ব্রিজের পাশের বাঁ দিকের সরু টার্নটাও ছেড়ে কিছুটা কিংকর্তব্যবিমুঢের মতই উঠে গেলাম ব্রিজে। আর তারপরই বিপত্তি। গুগল বাবা ব্রিজের মাথায় বাঁদিকে ফেরার রাস্তা দেখাচ্ছিলেন যেটা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। অগত্যা, আবার বেশ খানিকটা এগিয়ে U টার্ন নিয়ে ফিয়ে এসে আবার লোকালিটিতে প্রবেশ।
বেশ ভিড়ভাট্টা বহুল রাস্তার মধ্যে দিয়ে নেভিগেশনের দিকে চোখ রাখতে রাখতে গিয়ে পৌঁছালাম কোন এক চার মাথার মোড়ে। সেখানে আবার সবই ডব্ল রাস্তা। নেভিগেশনের দিকে চোখ রাখতে রাখতেই কিভাবে কোন টার্নটা কি-বুঝে ঠেলে গিয়ে ঢুকলাম যে লেনে গাড়ি আসে (ডাউন লেন) সেই লেনে। ব্যাস, পালাবার পথও আর নেই। ওপাশ থেকে গাড়ির রাশিও এগিয়ে আসছে। ভালো ছেলেটির মত গাড়ি কোনরকমে ঘুরিয়ে একটু সাইড করলাম। পেছনেই আমার অপেক্ষা করছিল সিভিক গার্ডেরা। নিমন্ত্রন দিয়ে নিয়ে যাওয়া হল মোড়ের মাথার ট্রাফিক কন্ট্রোল রুমে বড়বাবুর কাছে। বিস্তারিতভাবে নিজের ভুল স্বীকার করা এবং নিজের ডকুমেন্ট পেশ করার সাথে আর এক সিভিক গার্ড এসে আমাকে ‘সাইডে চলুন সাইডে চলুন’ করে রুমের সাইডে নিয়ে গেল, এবং দেয়া নেয়ার কথা শুরু হল।
অভ্যাসগত রেকর্ডেড পেনাল্টিগুলো শোনাতে শুরুই করেছিলেন, আমি বাধা দিয়ে বললাম ‘দাদা, আমি জানি এসব প্রবলেমগুলো হতে পারে, এবং আমিও ভুল করেছি। এখন কত কি দিতে হয়ে এটাকে মেটানো যায় বলুন।’
রংরুটে এন্ট্রির জন্য সাধারনতঃ ২১০০ টাকার পেনাল্টি আমাকে বলা হল। অনেক আদ্যপান্তির পর ১০০০ টাকার চূনা লাগিয়ে তবে রাস্তা দেখানো হল। (ট্রাফিক ধারা এবং ফাইনের জন্য এখানে চোখ রাখতে পারেন)
এরপরেও কোন এক অজানি কারনে সরু অলিগলির মধ্যে দিয়ে ঢুকিয়ে (বেসিকলি পাড়ার সরু গলি) গুগল বাবা আমাদের নিয়ে চলল কোন এক নিরুদ্দেশের উদ্দেশ্যে। কোথাও কোথাও নেভিগেশন তো এতই সন্দেহজনক হয়ে উঠল যে রাস্তার লোককে জিজ্ঞাসা করতে শুরু করলাম। এবং অনেক ক্ষেত্রেই তারা গুগলের বিপরীত রাস্তা দেখিয়ে দিল এবং সেই রাস্তায় চলার পর গুগল আবার রি-রুট করতে থাকল। আমাদের অদূরবর্তী গন্তব্য ছিল কোন এক কাঠের ব্রীজ। তারই আগে নেহেরু শিশু উদ্যানের কাছে রাস্তা দু’ভাকে বিভক্ত। গুগলের রাস্তা ধরে কিছুদূর যাবার পরে সন্দেহপ্রবন হয়ে রাস্তায় লোককে ফের জিজ্ঞাসা করলাম। তার শুনে বলল আপনারা উলটো রাস্তায় এসেছেন। যেখানে রাস্তা দু’ভাগে বিভক্ত হচ্ছে সেখানে অন্য রাস্তাটা নিন। গুগলের দিক-নির্দেশের কথায় তারা বলল এদিকে একটা পুরানো ব্রীজ আছে কিন্তু তার ওপর দিয়ে গাড়ি আর যায় না। ওহ্ মা..
অন্য রাস্তা ধরে বেশ খানিক্ষন মাটির উঁচুনিচু রাস্তায় অফ্-রোডিং করতে করতে যখন দামোদর নদীর ওপর সেই কাঠের ব্রীজের সামনে গিয়ে পড়লাম, আমাদের মুখ হাঁ-ই থেকে গেল।
মাটির ঢালু রাস্তায় বেশ খানিকটা নিচে সুবিশাল দামোদর নদী কল্কল্ করে বয়ে যাচ্ছে। যেমন ব্যাপ্তি তেমন চওড়া। তারই ওপর নিচু কাঠের তৈরী সাঁকো, যার মধ্যে দিয়ে একটা চার চাকার ছোট গাড়ি কোনরকমে পার হতে পারে। এছাড়া মানুষ, সাইকেল, লোকাল যানবাহন চলাচলও আছে। একে বলে রাইড অফ্ এ লাইফ (অন্তত আমার ক্ষেত্রে)।
খানিক্ষন দাঁড়িয়ে বুকে সাহস সঞ্চয় করে, ধীরে ধীরে পায়ে গাড়ি গড়িয়ে নিয়ে গিয়ে সাঁকোতে উঠলাম। আহা, সে কি মচ্মচে্ আওয়াজ চাকার নিচে। কাঠের তক্তার ক্যাঁচ কোঁচ আর আর জলের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ।


ক্যামেরার ফোকাস বেগড়ানোর জন্যে এবং (আমাদের) কিছু আজেবাজে কথোপকথনের জন্য (ভিডিওতে), দুঃখিত 😛 (আশা করি অভিজ্ঞতাটা বোঝার জন্যে যথেষ্ট)।
তবে নিঃসন্দেহে কাঠের এই নির্মানটি বানানো এবং সংরক্ষনের শ্রেয়টুকু যায় এখানকার লোকালদের। সাঁকোর অপরপ্রান্তে এটি পারাপারের জন্য একটি টোলেরও বন্দোবস্ত রয়েছে, আমার মনে হয় যা খুবই সমর্থনীয়, এই সাঁকোটির রক্ষনাবেক্ষনের জন্য। ৬০ টাকা, LMVs.
এর পরে আরো বেশ কিছুটা পথ গ্রামের মেঠো অলিগলি মধ্যে দিয়ে গিয়ে আমরা পৌঁছালাম WBSFDA‘র বিহারীনাথ রিসর্টে, তখন বেলা ১২ টা। বাবা বিহারীনাথের মন্দিরের পাশেই, বিহারীনাথ পাহাড়ের পাদদেশে গভমেন্টের এই রিসর্ট। এক নজরে দেখলে খুবই দারুন জায়গা। তবে সন্ধ্যের পর থেকে আর করার কিছু থাকে না। চারিদিক অন্ধকার হয়ে যায়, রিসর্টের ঘরের সামনেগুলোতে কেবল একটা করে টিমটিমে লাইট ছাড়া আর কিছু বন্দোবস্ত নেই, তাই বাইরে দু’দন্ড বসারও জো নাই, আর ঘরেতে টিভিরও বন্দোবস্ত নেই। তাই ঘরের টিমটিমে আলোয় বসে থাকা ছাড়া আর করার কিছু থাকে না। বাইরেও কোথাও ঘোরার জায়গা নেই বা সেরম দোকানপাট, কেবল পাশে মন্দিরে গিয়ে বসে থাকা ছাড়া। যাইহোক, সে আর এক কথা।
রিসর্টের বিশাল গেটের সামনে পৌঁছে কাউকেই যখন আর পেলাম না, নিজেরাই দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলাম। কিন্তু আরো বেশ কিছুটা সময় গেল কোন জনমানিষ্যির খোঁজ পেতে। যেন পুরো রিসর্টটাই হঠাতি মানুষ ফেলে চলে গেছে। রিসেপস্ন কাম্ খাবার ঘরের সামনে দুটো বাইক দাঁড় করানো আছে, কিছু জামাকাপড় শুকচ্ছে, কিন্তু কোথাও কোন মানুষের চিহ্ন নেই, পরিত্যক্ত এবং চুপচাপ।
এরপরে কোন এক ঘরের দরজা খোলা দেখে দরজায় গিয়ে ডাকাতে এক টাওয়েল পরিহিত ব্যাক্তি বেরিয়ে এলেন, এবং অবশেষে উঁনিই আমাদের রুমের বন্দোবস্ত করে দিলেন। জিজ্ঞাস করাতে জানতে পারলাম পাহাড়ে কাজ হচ্ছে, সরকারী বাবুরা এসেছেন, তাই ছেলেরা ওখানে আছে।
রিসর্টের ভেতরে সিংহভাগ অংশ বাগানের, সেখানে নানান গাছপালা, সরু রাস্তা, পার্কিং এসবের জায়গা আছে। বাগানের অপর দিকটি রিসর্টের রুমগুলির জন্যে। পাহাড়ের ঢালানের একটু উঁচুতে তিনটি রুম নিয়ে এক একটি কটেজ। সবই নীল রঙে রাঙা। ঠাণ্ডা থাকার দরুন আমরা একটি নন্-এসি রুমই বুক করেছিলাম, তো তারই একটি কটেজের মধ্যে থেকে একটি রুম আমাদের ধার্য্য করা হল। পাহাড়ের ঢালানে থাকার দরুন ঘরগুলির মেঝেতেও ঢালান স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। রুম মোটামুটি, দুটি সিঙ্গল বেড একসাথে করে ডব্ল করা, একটা স্টিলের আলমারি যাতে বিছানার জিনিষপত্রাদি, কিছু প্লাস্টিকের চেয়ার, একটা ছোট টি-টেবল এবং বাথরুম। তবে বিছানার জিনিষপত্রাদি যে খুব একটা পরিছন্ন সেটা বলা যায় না।
যাইহোক, ১২ টা বেজে যাওয়াতে দুপুরের খাবার মন্দিরের পাশে লাগোয়া একটি হোটেলে করে আসতে বলা হল। আর এখান থেকেই রিসর্টের মজা শুরু হল।

পাশের এই খাবারের হোটেলটি যে ব্যাক্তির, সেই আবার এখানের (রিসর্টের) খাওয়া-দাওয়ার দন্ডীয়মান ব্যাক্তি। ইনি মন্দিরের সামনে একটি ভাতের হোটেল চালান, যেখানে তেলেভাজা, ছোটখাটো মন্ডামিঠাই এসব বিক্রি হয়, সকালে হোটের খোলার আগে ইনি রিসর্টের রান্নাঘরে এসে কয়েকঘন্টা খেটে যান (গেস্টদের সকালের টিফিন বা লাঞ্চ), এবং রাত্রে হোটেল বন্ধের পরে রিসর্টে এসে আবার কয়েক ঘন্টা খাটেন গেস্টদের রান্নাপত্রাদির জন্যে। মাঝখানে কোন খাবার ব্যবস্থা নেই, আর খেতে হলে ওঁনার হোটেলে গিয়ে যদি যা পান খেতে হবে।
দুপুর হয়ে যাওয়ায় কেবল ভেজ (থালি) পাওয়া গেল, আলুভাজা, ভাত, ডাল এবং একটি তরকারি। অগত্যা তাই খেয়ে যখন থালির দাম শুনলাম, কোথাও একটা বেল বেজে গেল মাথার পেছনে। ৪০ টাকা এই থালি। যাইহোক, আমাদের বলা হয়েছিল রাত্রে কি খাবেন ওঁনাকেই বলে আসতে। সেই হিসাবে সন্ধ্যেবেলায় পাকোড়া/পিঁয়াজি আর রাত্রে চিকেন/ভাতের কথা বলে আসলাম। ৬ঃ৩০ নাগাদ পাকোড়ার পতিশ্রুতি নিয়ে ফিরলাম।






মন্দির থেকে ফিরে ম্যানেজারের কাছে পাহাড়ের ওপর এক বাবার কথা শুনি যিনি অনেকদিন ধরে ওখানে আছেন, অনেক লোকে নাকি যায় তাঁকে দেখতে, আর ইচ্ছা হলে একটু পাহাড় দিয়েও ঘুরে আসতে পারেন। এরপর পাহাড়মুখী প্রস্থান। বাবার ডেরাটা তাও বেশ অনেকটা উঁচুতে। Jr. কে নিয়ে অনেকটা চড়াই হাইকিং করে তবে সেখানে পৌঁছলাম। রাস্তা খুবই পাথুরে এবং প্রশস্ত। যাইহোক, একটু অসময়ের জগিং হয়ে গেল বলা চলে। বাবার ডেরাটি মন্দ নয়। ভদ্রলোক কলকাতারই, গত দু’বছর আছেন ওখানে। কুটীরের পাশেই একটি মাটির তৈরী মন্দির। একটি সরু নালা দিয়ে কুলুকুলু করে বয়ে যাচ্ছে কোথাও থেকে উঠে আসা জল, ওটাই বাবার পানীয়। কিছুক্ষন বসে সামান্য এটা সেটা কথা বলে আমরা আবার নামার রাস্তা ধরলাম।



এরপর ঘরে এসে বিশ্রাম নিতে নিতে কখন চোখের পাতা এক হয়ে গেছে খেয়াল নেই। ঘুম ভাঙল যখন তখন চারিদিকে অন্ধকার, সন্ধ্যে নেমেছে। খিদেটা অনুভব করলাম, আর তখনি পাকোড়ার কথা মনে পড়ল। যাইহোক, একটু ফ্রেশ হয়ে আমরা মোবাইলের টর্চ জ্বেলে পাশে মন্দিরের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। চারিদিকটা বড়ই শুনশান এবং অন্ধকার। উদ্দেশ্য একটু মন্দির দিয়ে ঘুরে আসা আর পাশের হোটেল থেকে একটু চা খেয়ে আসা (খাবার তো এখুনি আসছে না)। একটু চা বিস্কুট খেয়ে, শিগগিরি আসবার পতিশ্রুতি নিয়ে (হোটেলের মালিকের) আমরা কিছু পরে ফিরে এলাম। রাঁধুনী আসলে তবে রান্নাঘর খুলে রান্না হবে এবং আমাদের টিফিন জুটবে। কাছাকাছি আর কোন দোকানো নেই, আর আমাদের ভাগ্য খারাপ এবারে সেরম কিছু মজুতও করা হয়নি আমাদের।
ঘরের টিমটিমে আলোতে অপেক্ষা করতে করতে ৬ঃ৩০ গড়িয়ে ৭ঃ০০ হল। খিদে তখন মাথাচাড়া দিতে শুরু করেছে। বাইরে গিয়ে খোঁজাখুঁজি শুরু করলাম ম্যানেজারের। (এখানে বলে রাখি সেই তোয়ালে পরিহিতই এখানের ম্যানেজার কাম্ কেয়ার-টেকার সবই) কিন্তু উপস্থিত এক বৃদ্ধর কাছ থেকে জানলাম ম্যানেজারবাবু আজকের মত বিদায় নিয়েছেন। খাবার কথায় সে বলল আমি খবর পাঠাচ্ছি দোকানে।
আবার অপেক্ষা। ৭ঃ০০ গড়িয়ে ৭ঃ৩০ হল, কিন্তু বাবুর পাত্তা নেই। তিনি দোকান বন্ধ করে আসবেন তবে খাবার জুটবে। আমাদের ঘরের ঠিক পাশেই দু’পরিবারের আর একটি গ্রুপ উঠে এসেছিল, সাথে দুটো বাচ্চাও ছিল। বাচ্চাগুলো কানে আসছিল ঘরে বসে বসে শুয়ে পড়ছে। সেই পরিবারও বাইরে গিয়ে বার বার তাগাদা দিয়ে আসছিল, কিন্তু বৃথা। এদিকে আমারও খিদেতে মাথা বিগড়াতে শুরু করেছে, রাগ একরাশ চাপা বিরক্তি.. ৭ঃ৪০ নাগাদ বাবু পদার্পন করলেন। তাও ভালো Jr. -এর এখনো দুধেই কাটে, ওও আমাদের মত খাওয়া-দাওয়া শুরু করলে বেচারাকে বসে থাকতে হত। ৮ঃ০০ নাগাদ ৬ টি পিঁয়াজির আবির্ভাব হল, খিদের মুখে সেগুলো সাথে সাথেই শেষ হয়ে গেল। এর মধ্যে পাশের ঘরের ভদ্রলোকেরা সন্ধ্যের খাবার ক্যান্সেল করে দিয়েছেন।
৯/৯ঃ৩০ নাগাদ ভাতের জন্য অপেক্ষা করতে করতে ১০ঃ০০ পর্য্যন্ত গড়ালো। খাবার ঘরে গিয়ে খেতে খেতে আর কোন কথা বলার মত রুচি ছিল না। এদিকে বাবু রান্না করে আমাদের পাশেই একটা চেয়ারে বসে পা নেড়ে নেড়ে (যেন কিছু একটা কাজ করেছি বলুন!) গল্প করার মুডে আছে দেখলাম। পাশের ভদ্রলোকেরা জেনে নিচ্ছিলেন কোন খাবারের কিরম দাম, দামের বহর শুনে আমাদের ভ্রু কোঁচকানোই সাঙ্গ ছিল। ভদ্রলোকের একটা প্রশ্ন খুব ইন্টারেস্টিং লাগল। থালির প্রশ্ন উঠতে যখন দাম বলা হল, তখন ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন তোমার হোটেলে ৪০ টাকা আর এখানে ৬০ টাকা কেন? বিন্দুমাত্র সময় খরচ না করে দোকানী যুক্তি দিয়ে বোঝাতে শুরু করে দিল, এখানে এসে যে কাজ করছি তার তো একটা খরপোষ আছে নাকি? অর্থাৎ, যে থালির দাম বাজারে ৪০ বা কাছাকাছি হতে পারে, সেটাই এখানে ৬০ টাকা দিয়ে খেতে হচ্ছে কারন WBSFDA‘র কোন নিজস্ব ব্যাবস্থাপনা নেই বলে। WBSFDA তার ব্যাবস্থাপনার সম্পূর্ণ টাকাটি রেখে দিয়ে এদেরকে বলে দিয়েছে তোমরা তোমাদের মত বুঝে নাও।
“খাবারের ব্যাপারে যা বলবার আমাকেই বলতে হবে।” – বেশ হত্তাকত্তা ভাব একটা। নেক্সট ডে’তে যাতে ওঁর হোটেলে গিয়ে না আবার অর্ডার করতে হয়, সকালের জলখাবারের অর্ডারটা আমরা ওখানে দিয়েই সেদিনের মত এসে বিছানা নিলাম।
.
পরদিন সকালে ৯ টা নাগাদ আমরা খাবার ঘরে গিয়ে পৌঁছালাম। কিছুক্ষন অপেক্ষা করার পর রাঁধুনীর হোটেলেরই এক কর্মচারী একটি ঠোঙায় কচুরী আর পাত্রে তরকারি নিয়ে এল। শালপাতার থালায় পরিবেশন করে দিয়ে চলে গেলেন। আগের দিনের বিরক্তিটা তখনও কাজ করছিল। ম্যানেজারকে খুঁজছিলাম একটু জিজ্ঞাসা করব বলে যে কি ধরনের ব্যাবস্থাপনা আপনাদের। কিন্তু ভদ্রলোককে দেখলাম না কাছে পিঠে। বিরক্তিটা থেকেই আর দুপুরের খাবার অর্ডার করলাম না, ঠিক করলাম বরন্তির ওদিকটা গিয়ে কোথাও দেখব, তারপর রাত্রে দেখা যাবে।
বিহারীনাথ থেকে বরন্তি কাছেই, মাত্র ৪০-৪৫ মিনিটের পথ গাড়িতে। ইদানীংকালে বরন্তির নামও খুব উঠে আসছে ভ্রমনরসিকদের থালায়। তাই কাছে এসে একবার দর্শন না করলেই নয়। বেশ খানিক্ষন ম্যানেজারের অপেক্ষা করে বরন্তির উদ্দেশ্যে প্রস্থান করলাম। গতকালের বৃদ্ধই একমাত্র দেখলাম রয়েছেন রিসর্ট আগলে এবং তাঁর কাছে ওঁনার কোন ফোন নাম্বার নেই। একটু প্রমাদ গুনতে গুনতেই প্রস্থান করলাম যে কি জানি কি আছে আজ আবার কপালে (কখন কি খাবার জুটবে)। বলাই বাহুল্য, গুগল বাবাজী এবারেও সাথে ছিলেন।
এরপর গুগল ম্যাপ আমাদের কোথায় কোথায় দিয়ে যে নিয়ে বের করল তার ঠিক নেই। গ্রামের মেঠো পথ, গলি-ঘুঁজি, অফ-রোডিং কিছুই বাকি ছিল না তাতে। আমার খুব আশ্চর্য্য লাগছিল যে এত বড় বড় গাড়ি বিহারীনাথ থেকে বরন্তি যায় (আগের দিনি দেখেছিলাম দুই বড় Winger ভর্তি লোকজন বিহারীনাথ মন্দিরে এসেছিল, সেখান থেকে আবার বরন্তি গেল), তারা তো নিশ্চই এই গ্রামের গলি দিয়ে যাবে না! তাহলে আর কোন রাস্তা আছে? কিন্তু ম্যাপেও আর কোন অল্টারনেটিভ দেখাচ্ছে না। এইসব ভাবতে ভাবতেই গুগল বরন্তির কাছাকাছি আমাদের কোন এক ক্ষেতের আলের মধ্যে নিয়ে গিয়ে ফেলল। গাড়ি ঢুকিয়ে দিয়ে রীতিমত প্রমাদ গুনতে শুরু করলাম। দু’দিকে ক্ষেত নেমে গেছে। গাড়ি ঘোরাবার কোন জায়গা নেই। রাস্তা অতীব প্রশস্ত, কোনরকমে একটি ছোট গাড়ি চলতে পারে। বড়ই খারাপ এবং উঁচুনীচু। কোথাও গিয়ে যদি কোন কারনে আটকাতে হয় কি যে হবে ভেবে আত্মরাম খাঁচাছাড়া হতে শুরু করল। ফেরার কোন পথ নেই। পথিমধ্যে কিছু কিছু গ্রামীন লোকের আজব চেয়ে থাকা দেখে বুঝতে পারছিলাম, গুগল খেল দেখিয়েছে।
অনেকটা হয়ত এরকমই, দুদিকে ঝোপঝাড় বিশিষ্ট এবং এক গাড়ি যাওয়ার মত
কোনরকমে বেরিয়ে মোটামুটি পিচ রাস্তায় পড়ার পরই দেখি সামনে আর এক ক্ষেতের আল্ রাস্তায় ঢোকাতে চাইছে। আমি আর সেদিকে যাই নি, আগে লোককে জিজ্ঞাসা করার সিদ্ধান্ত নিলাম।
এরপর মূলত জিজ্ঞাসা করে করে একসময় বরন্তি ড্যামের রাস্তায় গিয়ে পড়লাম। বুঝতে দেরী হল না যে ডেমোগ্রাফি হিসাবে বিহারীনাথের থেকে বরন্তির দর কেন বেশী হতে পারে।
এখানে সেরম কোন ওপেন রেস্টুরেন্ট এখনো পর্য্যন্ত নেই, যা আছে হোটেল লজিং’এর মধ্যে। ড্যামের ব্যারেজ পেরিয়ে বাঁ দিকে ঘুরতেই মুরাডি ইকো ট্যুরিসম্ । গাড়ি বাইরে রেখে আমরা ভেতরে ঢুকলাম দুপুরের খাবারের আশায়। বিশাল বড় জায়গা নিয়ে এই ইকো ট্যুরিসম্, তার মধ্যে আবার অনেক জায়গায় এখনো কাজ চলছে। মাঝখান বরাবর এক বিশাল গোলাকার মাটি কাটা হয়েছে, পরে জেনেছি সেখানে ফোয়ারার কাজ হচ্ছে। ড্যামের অতীব কাছাকাছি হওয়ায় বরন্তি পাহাড় আর জলের রূপরেখা পরিষ্কার ধরা পড়ে এখান থেকে। লেকের দিকে ৪/৫ তলা উঁচু এক ওয়াচ্টাওয়ারেরও কাজ চলছে দেখলাম। দুটো বেশ বড় বড় টেন্ট, চারটি কটেজ এবং একটা বড় ডরমেটোরি, রান্না-খাবার ঘর এবং অনেক ফাঁকা জায়গা – এই নিয়ে মুরাডি ইকো ট্যুরিসম্। খিদেতে কিছুটা কাহিল হওয়া অবস্থাতেই রান্না-খাবার ঘরের সামনে গিয়ে যখন খোঁজ করলাম কিছু খাবার ব্যাবস্থা হবে কিনা, তাঁরা সাগ্রহে হ্যাঁ করল। বেশ সুন্দর পরিষ্কার-পরিছন্ন ডাইনিং রুমে গিয়ে বসানো হল এবং একটু সময় চেয়ে নেয়া হল, তারপরে তাঁরা রান্নাঘরের কাজে লেগে গেলেন। কিছুক্ষন অপেক্ষার পর গরম গরম ভাত, ডাল, তারকারি ইত্যাদি সহকারে সুন্দরভাবে সাজিয়ে আমাদের পরিবেশন করা হল। তখন কি ভালোই না লাগছিল, বিহারীনাথের খাবার পরিবেশনের পরিছন্নতার কথা মনে করে। খুব তৃপ্তি সহকারেই খেলাম। এরপর রুম খালি আছে কিনা জিজ্ঞাসা করায় তাঁরা মহা উৎসাহের সাথে আমাদের রুম দেখাতে নিয়ে গেল। যদিও তখনো আমরা কোন সিদ্ধান্ত নিইনি হোটেল চেঞ্জ করব কিনা।
টেন্ট এবং একটা কটেজ দেখানোর পর আমাদের তখন গলে ক্ষীর হবার মত ব্যাপার। একে তো সুন্দর জায়গা, তার ওপর বিহারীনাথ রিসর্টের যাবতীয় প্রবলেমের কথাগুলো মনে করে, এবং সেখানে সন্ধ্যের পরে যেখানে মূলত করার কিছুই থাকে না, এমনকি বাইরে বসা বা ঘোরার মতও থাকে না, আমরা চিন্তা করতে থাকলাম একদিনের হলেও একটু ভালো করে থাকা যায় কিনা। হ্যাঁ, সেদিনের বুকিংটা নষ্ট হবে বিহারীনাথে, এবং এখানের একটা এক্সট্রা খরচ। যাইহোক, কিছুটা আলোচনার পর আমরা একটা কটেজ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। সাহায্য হিসাবে মালপত্র নিয়ে আসবার জন্য একজন লোক দেয়া হল সঙ্গে যে আমাদের ঠিকঠাক রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে যাবে এবং নিয়ে আসবে (আমাদের রাস্তা বিভ্রাটের কথা শুনে)। এরপর অনেক সাবলীলভাবে এবং গাড়ি চলার মত রাস্তা দিয়ে আমরা আমাদের মালপত্র নিয়ে বিহারীনাথ ছেড়ে মুরাডি রিসর্টে এসে উঠলাম। বলাই বাহুল্য, গুগলবাবার রাস্তার থেকে অনেক অমিল ছিল এ রাস্তার।





এরপর দিনটা কাটলো বেশ ভালো ভাবেই। সত্যি বলতে কি, বিহারীনাথের থেকে অনেক ভালোভাবে। সন্ধ্যেতে ঘরের মধ্যে আটক থাকারও কোন কিছু ছিল না, ড্যামের পাশে ঘুরে, এদিক ওদিকে বসে বা টিভি দেখে সময় কাটানো, এবং খাওয়া-দাওয়ার কোন অসুবিধা ছিল না। রিসর্টের লোকজনও বেশ হেল্পফুল। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে বরন্তির সূর্য্যোদয়ের শোভা নিতে ভুল করলাম না।







এরপর আমরা সকালের জলখাবার সেরে বাড়ির পথ ধরলাম। তবে এবারে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জেনে নিলাম কিভাবে কোথা দিয়ে যাওয়া যায়। প্রত্যেকটা পয়েন্ট যেগুলো দিয়ে হাইওয়েতে পৌঁছানো যায়, এবং পৌঁছানো পর্য্যন্ত পুরোপুরি মানুষের সহায়তায় রইলাম এবং, নো গুগল বাবা। অবশেষে হাইওয়েতে ওঠার পর, আবার গুগল মহারাজই সব 🙂
মুরাডি ইকো ট্যুরিসমঃ
ম্যানেজারঃ ৭৪০৭৯৭১৪৫৬
অন্যান্যঃ ৯৭৩৩৪২৪৯৩৯/৮০১৬১৪৪৩২৩
ইমেলঃ ecotourdometory16@gmail.com
খুব সুন্দর লেখা।
LikeLiked by 1 person
খুব সুন্দর বর্ননা
LikeLiked by 1 person