বেরিয়েই পড়লাম অবশেষে।
ইদানীং যাবত সোসাল মিডিয়ায় একটা নাম খুব উঠে আসছিল, আম্বিকা কালনা। কালনা নগরীর নাম তো শুনেছি, কিন্তু কখনও সেভাবে কৌতূহল বোধ করিনি। এটির সম্বন্ধে প্রথম শুনি ফেসবুকের ট্রাভেল গ্রুপ ‘বং ট্রাভেলারস’এ তে (https://goo.gl/oypQNn)। তারপর এদিক ওদিকে আরো কয়েকজনের কালনা দর্শনের কথা শুনি ফেসবুকের পেজে। একটা উইকএন্ড ট্রিপ করার ইচ্ছা ছিল, আর এরম একটা জায়গা শুধু টোপ ফেলার মত।

খুব বেশী ঐতিহাসিক তথ্য না নিয়ে কেবল যেটুকু ঘোরার জন্য প্রয়োজন, সেটুকু নিয়েই বেরিয়ে পড়লাম। কলকাতা থেকে গাড়িতে ২.৩০ ঘন্টার দূরত্বে অবস্থিত কালনা বা অম্বিকা কালনা পূর্ব বর্ধমানের একটি উপনগরী যা অনেকের কাছে ‘মন্দির নগরী’ হিসাবেও পরিচিত, এবং যেটি একদিনের রাউন্ড ট্রিপের জন্য আদর্শ।
বছর শীতের ঝাঁকুনির সাথে বড়দিনের আগের’ ছুটির মেজাজ নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম নগর কালনার উদ্দেশ্যে। রবিবারের ৭ টার সকাল, হালকা রোদ্দুরে শীতের মোড়ক তখনও কাটেনি, কিন্তু রাস্তায় তখনই যেন অনেক ভিড়। পরদিন বড়দিন, তাই অনেকেই হয়ত ছুটির সুযোগটা হারাতে চায় না। রাস্তায় বিভিন্ন সাইজের গাড়ির মধ্যে আমরাও ছুটে চললাম মাথা উঁচু করে।
সাঁতরাগাছি ঘুরে দিল্লী রোড ধরে ডানকুনির আগে ডানদিকে বাঁক, স্টেট হাইওয়েতে পড়ার পর রাস্তা খারাপ হতে শুরু করল। বেশ কিছুক্ষন চলার পরে রাস্তা আবার একটু ভদ্রস্তও হল। এরপর এরকমই ভালো খারাপের পরে যখন SH6 -এ উঠে এলাম তখন সত্যি রাস্তা এত ভালো হয়ে গেল যে ড্রাইভিং করতেও ভালো লাগছিল। যদিও ডবল-ওয়ে লেন, কিন্তু এত সুন্দর রাস্তা হয়ত খুব কমই পাওয়া যায়।
বিভিন্ন কারনে কালনা পৌঁছতে ১১ঃ৩০ বেজে গেল। পৌঁছে আগে যেটার খোঁজ করা হল সেটা হচ্ছে একটা টোটো। এখানের দর্শনীয় স্থানগুলি এতই গলি-গালার মধ্যে অবস্থিত, গাড়ি নিয়ে যাওয়া গেলেও বোধহয় একটা টোটো নিয়ে ঘোরা আরও সহজ এখানে। টোটো ঘন্টা প্রতি ২০০ টাকা। টোটো ঠিক হওয়ার পরে টোটোওলাই আমাদের গাড়ির পার্কিংয়ের ব্যাবস্থা করে দিল, বাস স্ট্যান্ডে। আর বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে বেরিয়ে পড়লাম কালনা দর্শনে।
মা অম্বিকা মন্দির
অম্বিকা কালনা এখানকার অন্যতম আরাধ্য দেবী অম্বিকা’র (মা কালী) নামানুসারে হয়েছে। কালনা শহরে গিয়ে তাই মা অম্বিকার দর্শন না করে ফেরা যায় না। টোটোওলা বললেন তাড়াতাড়ি যেতে হবে, ১টা নাগাদ মন্দির বন্ধ হয়ে যায়। যাই হোক, আমরা সময়ে পৌঁছলাম এবং মা’কে পূজোও দিতে পারলাম। এখানে মায়ের রূপ থেকে চোখ ফেরানো ভার (আমি যদিও সেরম কোন ভক্ত নই, কিন্তু তার সাথে বোধহয় মায়ের রূপে মুগ্ধ না হবার কোন কারণ নেই)। সেকেলে আটপৌড়ে শাড়িতে সুসজ্জিতা দেবী অম্বিকা সত্যি দর্শনীয়।

রঙের উজ্জ্বলতায় লাগোয়া শিব-মন্দির গুলি

মা অম্বিকার মূল মন্দির

মা অম্বিকা
১০৮ শিব মন্দির এবং রাজবাড়ি
এরপর আমরা চললাম ১০৮ শিব মন্দির এবং রাজবাড়ির উদ্দেশ্যে। টোটোয় যেতে যেতে বারংবারই মনে হচ্ছিল নগর কালনা অনেকটা শ্রীরামপুরের মত। সেখানের রাস্তাঘাট, অলিগলি, বাড়িঘরের সাথে কালনার যেন প্রভূত মিল আছে। হয়ত শহরতলীর নগরগুলো এরকমই হয়।
ছুটির দিন হবার দরুন আমাদের আগেই অনেক দর্শনার্থীর ভিড় জমেছে সেখানে। পৌঁছানর পরই টোটোওলা বললেন ১০৮ শিব মন্দির আগে ঘুরে নিন, আর আধ ঘন্টা পরে হয়ত বন্ধও হতে পারে (লাঞ্চ ব্রেক), অথবা আরো কিছুটা সময় যেহেতু আজ অনেক লোক এসেছে।
দুটি গোলাকার বৃত্তে সাজানো শিব মন্দিরগুলি, বাইরের বৃত্তে ৭৪ টি এবং ভিতর বৃত্তে ৩৪ টি। বাইরের বৃত্তের মন্দিরগুলিতে একটিতে সাদা তো একটিতে কালো শিবলিঙ্গ অবস্থিত, ভিতরের গুলিতে কেবলই সাদা। মন্দিরের বাগান/মাঠ গুলি এত সুন্দরভাবে রক্ষনাবেক্ষন করা হয়েছে যে নজর কাড়ার মত।
(clickable)
রাজবাড়ি ঠিক ১০৮ শিব মন্দিরের উল্টো দিকেই। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ডাবের জল খেয়ে রাজবাড়িতে প্রবেশ (ডাবের জল নিজের পয়সায়)।
রাজবাড়ি বিভিন্ন ছোট এবং বড় মন্দির এবং তাঁদের চোখ টানা টেরাকোটার কাজে সমৃদ্ধ, যার কিছু কিছু ১০০ বছরেরও পুরাতন। উল্লেখ্য প্রতাপেশ্বর মন্দির (অভূতপূর্ব টেরাকোটার কাজ), রাস মঞ্চ, লালজি মন্দির (যা পশ্চিম বাংলার ৫ ২৫-চূড়ার মন্দিরের মধ্যে অন্যতম বলা হয়), গিরিগোবর্ধন মন্দির (যার দল ছাড়া (কিছুটা যেন বিদ্রোহীও) শিল্পকলা কিছুটা যেন বুদ্ধের জটার কথা মনে করিয়ে দেয়), কৃষ্ণচন্দ্র মন্দির (যা আরো একটি ২৫ চূড়ার মন্দির কিন্তু লালজি মন্দিরের থেকে ছোট)। সুন্দর শিল্পকলার দিকে তাকাতে তাকাতে সময় কোথা থেকে কেটে যাবে, বোঝাও ভার।



(clickable)
অম্বুলি (তেঁতুল) বৃক্ষ
রাজবাড়ি থেকে বেরিয়ে এবং অম্বুলি বৃক্ষ দর্শনের আগে টোটোওলা আমাদের নিয়ে ফেল্ল গৌর-নিতাই মন্দিরে। পুরাতন দালান মন্দিরের দালানে তখন ভক্তের ভিড়ে নাম-গান হচ্ছে। পাশে চলছে ভোগের রান্নাবান্না। কিছুক্ষন কাটিয়ে আমরা প্রস্থান করলাম অম্বুলি বৃক্ষের উদ্দেশ্যে। কথিত আছে এখানে শ্রী চৈতন্যের পদধূলি পড়েছিল। শ্রী চৈতন্যের পায়ের ছাপ সংগৃহীত একটি ছোট মন্দির নিয়ে ছেয়ে আছে ৫০০ বছরেরও বেশী পুরতান এই অম্বুলি বৃক্ষ। এখন এই পায়ের ছাপ সত্যি শ্রী চৈতন্যের কিনা সেটা বিশ্বাস করা ভক্তের ইচ্ছা (আর কথাতেই আছে, বিশ্বাসে মিলায়ে বস্তু তর্কে বহুদূর)। ছোট ঘেরা জায়গাটিতে সময় কাটাতে তবে মন্দ লাগে না।

অম্বুলি বৃক্ষ
দেবী ভবানী মন্দির
দেবী ভবানী মন্দির যা ভবা পাগলার জন্যেও বিখ্যাত (ভবা পাগলা কতৃক প্রতিষ্ঠিত), যাবার আগে ছোট্ট দর্শন সারা হল মহাপ্রভু মন্দিরে। কিন্তু তখন দর্শনের সময় পেরিয়ে গেছিল, তাই বাইরে দিয়ে ঘুরেই আমরা বেরিয়ে এলাম।
দেবী ভবানী মন্দিরে এঁর মা কালীর বিগ্রহ ছাড়াও আছে ভবা পাগলার এক অনন্য সংগ্রহ, যার মধ্যে আছে ভবা পাগলার নিজস্ব লেখা, আঁকা, ব্যাবহার্য্য জিনিষপত্রাদি এবং নাম-গান। এখানে ভবা পাগলার সমাধি মন্দিরও বিদ্যমান। মন্দিরে প্রবেশের পর মন্দিরের প্রসাদ হিসাবে একটা করে লজেন্স দেয়া হল (কোথাও ভবা পাগলার সূক্ষ ফ্যান রচনা হল আর’এক জন)।
এর পরে আরো অনেক কিছু দর্শনের ছিল, যার মধ্যে উল্লেখ্য গোপালজির মন্দির, জগন্নাথ বাড়ি মন্দির, দাতানকাঠি তালা মসজিদ (যার পাশ থেকে আমরা গিয়েছিলাম) ইত্যাদি। কিন্তু আমাদের সময় কম হয়ে গেছিল (দেরীতে পৌঁছানোর জন্য) এবং অতটা রাস্তা ঠেঙিয়ে ফেরারও ছিল। আমরা তাই প্রস্থানের পথই ধরলাম।
জয় মা কালী!
(কালনা সম্বন্ধে আরো জানার জন্যে http://y2u.be/27afRRvdgDg)
।
সমাপ্ত।।
Khub sundar hoyeche santanu.
Ruma from http://www.holidaystory.in
LikeLiked by 1 person
Thank you!
LikeLike
দারুন খুব সুন্দর। আমরাও খুব ঘুরতে ভালোবাসি আপনি যদি আমাদের ওয়েবসাইট ও দেখেন অথবা কমেন্ট করেন তো খব খুশি হবো আমরা
LikeLike