যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখো তাই
পাইলে পাইতে পারো অমূল্য রত্ন।
ছাই হয়ত ওড়ানোর প্রয়োজন নেই, তবে মানুষের ভিড় ঠেলা লোকালিটির বাইরে রত্ন বটেই।
বেড়ে ওঠা হাঁসফাঁস করা শহরগুলোর বাইরে একটু একান্ত এবং স্বতন্ত্র জায়গা খুঁজে পাওয়া যেন আমাদের সকলেরই কাম্য। কে না চায় কোন একটা অজানা অথবা কম-জানা জায়গাকে খুঁজে পেতে, তার রঙ রূপ গন্ধ, সেখানের ব্যাঞ্জন, মানুষ এবং কালচার – এগুলোকে উঠিয়ে নিয়ে আসতে নিজেদের স্মৃতির পাতায়। কিন্তু এরম লোকানো রত্ন খোঁজবার হলেই আমরা একটু কিংকর্তব্যবিমূঢ হয়ে পড়ি, কোনদিকে খোঁজা কিভাবে খোঁজা এসব নিয়ে একটু দিশেহার অবস্থা এসে যায়; আর এর পরে সেফ্টি, সম্ভাব্যতা এগুলোও আছে।
তবে (ছাইয়ের নিচে) রত্ন খোঁজার ব্যাপার এলে ভারতের ব্যাপ্তি নিয়ে কোন প্রশ্ন ওঠে না। এর বিশালতার মধ্যে যতই হারানো যায় ততই প্রতিক্ষনে কিছু নতুন জানার এবং দেখবার সুযোগ পাওয়া যায়।
এখানে সেরমই কিছু রত্নের হদিস রইল।
ভাসমান চার্চ
(কর্ণাটক)

পুরাতন ধবংসাবশেষের মধ্যে অনেকেরই একটা অগম্য টান থাকে। যত পুরাতন এবং দুর্গম হয় তা, ততই যেন আকর্ষনের বিষয় হয়ে ওঠে। আমাদের এই পরিত্যক্ত গথিক স্টাইলের চার্চ যা বেঙ্গালুরুর কিছুটা বাইরে অবস্থিত, সেখানে পৌঁছতে কিছুটা হাড়গোড় নাড়িয়েই পৌঁছতে হবে। তার মানে অন্য কারো হাড়গোড় নাড়াতে হবে না, কিন্তু পথের অবস্থাই সেই কাজটি করে দেবে। তবে ওবড়খাবোড় রাস্তা পেরিয়ে সেখানে একবার পৌঁছতে পারলে আফসোস করার কিছু থাকবে না।
রোসারি চার্চ, সেত্তিহালি শহরের বালুকাময় হেমাবতি নদীর তীরে অবস্থিত, এক-তৃতীয়াংশ (জলে) নিমজ্জিত এমনি একটি গথিক স্টাইলের চার্চ যা মানুষকে নির্বাক করবেই। চার্চের ছাদটি এখন আর না থাকলেও এর কারুকাজ এবং স্বতন্ত্রতা মুগ্ধ করবে। পড়ন্ত দিনের আলোর সাথে চার্চের স্থাপত্য ক্রমশঃ ভৌতিক হয়ে উঠলেও, চক্চকে দিনের আলোতে দেখার মজা আলাদা।
ফ্রেঞ্চ মিশনারি দ্বারা উনবিংশ শতাব্দীতে স্থাপিত চার্চটি ১৯৬০ সাল অব্দি বেশ বহাল তবিয়তেই ছিল, যতক্ষন না পর্য্যন্ত ইন্ডিয়ান গভর্নমেন্ট জল ঢেলে দিল। গরুঢ় ড্যাম প্রোজেক্টের কাজ শুরু হবার পর থেকে কাছাকাছির গ্রামবাসীর অন্যত্র প্রস্থান হলেও এই চার্চটি রয়েই গেছে। বছরের পর বছর বর্ষার প্রকপ যেমন সয়েছে, তেমনি ড্যামের ক্রমবর্ধমান জল ক্রমশঃ নিমজ্জিত করেছে চার্চটিকে। আজ এই অর্ধ বা বেশী নিমজ্জিত চার্চটি মানুষকে শুধু বিস্মিত করে।
(clickable)
ড্যামের ওপর তৈরী ব্রীজ বা নৌকার মাধ্যমে এর শোভা অন্বেষণ করা যায়। যদি ভাগ্য আরো একটু প্রসূত হয় তবে লোকাল ফিসারমেন দের সাহায্য নিয়ে তাঁদের গোল নৌকায় সওয়ারী হয়ে ঘুরে আসতে পারেন তাঁদেরই নির্দেশিত পথে। ভাসমান চার্চের অর্ধ-নিমজ্জিত খিলান আর ভগ্ন হলের মধ্যে দিয়ে ভেসে ঘুরে বেড়ানো এক আলাদা অভিজ্ঞতা বটেই। ভগ্ন দেয়াল এখন যা সামুদ্রিক জীবেদের বাসা, একটু হাত দিয়েও ছুঁয়ে দেখা যায়।
ঠিকানাঃ বেঙ্গালুরু থেকে ২০০ কিমি দূরে অবস্থিত সেত্তিহালির রোসারি চার্চ। গাড়িতে যা প্রায় ৪ ঘন্টার মতন। ব্যাঙ্গালোর-ম্যাঙ্গালোর হাইওয়েতে হাসান-এর নিকট পথ বদলে গরুঢ় ড্যামের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করতে হবে।
পাটান
(গুজরাট)
এক্সপ্লোরেশন যদি কারো নেশা হয়, তাহলে হয়ত পাটানকে উপেক্ষা করা সহজ নয়। গুজরাটের একটি স্বল্প ভিড়াক্রান্ত শহর, দু’দিকে কাঠের কারুকার্য্য খচিত ঘরবাড়ির শোভা বিশিষ্ট সরু রাস্তাঘাট, এবং এর ১০০-এরও বেশী জৈন মন্দিরের স্থাপত্যকলা নিয়ে, পাটান। এর সাথে এখানের হাতে বোনা শাড়ির জুড়ি মেলা ভার।
প্রাচীরের মত দেয়াল দ্বারা বেষ্টিত, যেখানে পৌঁছাতে হলে অতিক্রম করতে হয় এর রাজকীয় দ্বারগুলি, এক অতি প্রাচীন কিন্তু আধুনিক মনের শহর পাটান সাক্ষী থেকেছে অনেক কিছুরই তার ৬৫০ বছরের ইতিহাস নিয়ে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের মূল রচিত হয়েছে এখানে, সাক্ষীও থেকেছে অনেক যুদ্ধের।
‘রানী কি ভব্‘ (রানীর ধাপমান কূপ) – UNESCO World Heritage Site -এ সম্প্রতি যার নাম নথিভূক্ত হয়েছে, এখানেই অবস্থিত।
এছাড়াও এখানের দর্শনীয় জায়গার মধ্যে আছে ১০০০ বছরের পুরাতন কালী মন্দির, সহর্সলিঙ্গ তালাভ্ (সোজাসুজি বললে ১০০০ লিঙ্গ হ্রদ) যার অতীবসুন্দর বিন্যাস সরস্বতী নদীর জলকে শহরে নিয়ে আসে, খান সরোবর, এবং জৈন মন্দিরের রাশি তো আছেই। একটা দিন যদি এই শহর অন্বেষণের জন্য কাটানো যায়, হয়ত কম ই মনে হবে।
ঠিকানাঃ আহমেদাবাদ থেকে ১২৫ কিমি দূরে, সবচেয়ে কাছের ট্রেন স্টেশন আহমেদাবাদ-পাটান লাইনস্।
গলফ অব্ মান্নার
(তামিল নাড়ু)

অবিশ্বাস্য মনে হলেও এরম নীলাভ জল, গোঁতাগুঁতিহীন সমুদ্রের বীচ এবং বিদেশের মত সামুদ্রিক জীবন যেখানে সামুদ্রিক কচ্ছপ, ডলফিন এবং তিমির দল হেসেখেলে বেড়ায়, এরম উপকূলও ভারতে আছে। রামেস্বরম দিয়ে শুরু করে আরো দক্ষিনে অবস্থিত গালফ অব্ মান্নার – নিজগুনে এক আশ্চর্য্য মাত্র।
দক্ষিন ভারতের একটি ছোট দ্বীপ পম্বনে অবস্থিত রামেস্বরম (পম্বন দ্বীপকে আবার রামেস্বরম দ্বীপও বলা হয়), এবং ভারতের মূল ভূগন্ডের সাথে যুক্ত হয়েছে পম্বন ব্রীজ দ্বারা। এখানে গালফ অব্ মান্নার জৈবিকভাবে ভারতের সেরা উপকূল হবার সুবিদার্থে পরিযায়ী সীগাল আর ত্রয়ী পাখিদের ভিড় লেগে থাকে। আর আছে এর ফল-ফুলন্ত কোরাল রীফ, যার ৩৬০০’এরও বেশী জীবজগৎ নিয়ে এক ব্যাস্তময় জগত।
(clickable)
এসবের মধ্যে আরো একটা জিনিষ যেটাকে না বললেই চলে না, বরং অনেকের আকর্ষনের কারন – ধনুষকোড়ি শহর। ভূতের শহরও বলে থাকে অনেকে। পরিত্যক্ত গ্রাম, ফেলে আসা ধ্বংসাবশেষ, এবং এর এক রহস্যময় টান – যা এখানে আসা কোন মানুষই উপেক্ষা করতে পারে না। রোমাঞ্চ সন্ধানী অনেক ট্যুরিস্টই এসে উপস্থিত হয়ে এখানে, তবে ট্যুরিস্যমের কোন ব্যাবস্থা নেই।
ঠিকানাঃ সবথেকে কাছের বিমানবন্দর মাদুরাই এখানে থেকে ১৪০ কিমি দূরে। রেলপথে রামেস্বরম ভারতের অনেক গুরুত্বপূর্ণ জায়গার সাথে যুক্ত, যেমন চেন্নাই, মাদুরাই, কোয়েম্বাটোর ইত্যাদি। সড়কপথে চেন্নাই এবং মাদুরাইয়ের সাথে যোগ আছে।
নারারা মেরিন ন্যাশানাল পার্ক
(গুজরাট)
গোড়ালি ভেজা জলে অক্টোপাস, পাফার ফিস্, শংকর মাছ, কোরাল ইত্যাদি দেখতে কেমন লাগবে। বা, কখনও কি ভাবতেও পারি তাও সম্ভব! কিন্তু এ ভূভারতে সেটাও সম্ভব।
নারারা মেরিন ন্যাশানল পার্ক, জামনগর গুজরাট – গলফ্ অব কচ্ছের উপকূলে এমনি এক আন্তঃ জোয়ার স্থান যেখানে হেঁটে গোড়ালি ভেজা জলে সামুদ্রিক জীবজগৎকে দর্শন করা যায়। ১৭০ কি.মি. অঞ্চল বিশিষ্ট নারারা সম্পূর্নটাই নিমজ্জিত থাকে জোয়ারের সময়, এবং জোয়ার কেটে গেলে প্রকাশিত করে এর অদ্ভুৎ জীবজগৎকে। এখানে দিনে ৪ বার জোয়ার-ভাটার উদয় হয় – ২ বার জোয়ার (প্রতি ১২ ঘন্টা কালীন) এবং ২ বার ভাটা। নারারার কোরাল জগতের মধ্যে দিয়ে হাঁটা ভাটার সময়ই একমাত্র সম্ভব এবং জল পুরোপুরি উঠতে আবার ৩.৫ ঘন্টার মতন সময়ে।
(ছবি – জনৈক, clickable)
এখানে ক্যানো ভাড়া করে যেমন এর ম্যানগ্রোভ জঙ্গল পরিদর্শন করা যায় তেমনি সাইক্লিংয়ের জন্যে নির্দিষ্ট পথ থাকার দরুন বাইকে করে সাগরের চমৎকার দৃশ্যও দর্শন করা যায়।
ঠিকানাঃ জামনগর থেকে ৬০ কি.মি. দূরে (দ্বারকা-অভীমুখে) নারারা অবস্থিত। এখানে ফরেস্ট ডিপার্মেন্টের পারমিশনের দরকার পড়ে পরিদর্শনের জন্যে।
lovely
LikeLiked by 1 person