২০০৯ এর শেষ, শীতের ঠান্ডার সাথে সম্পর্কের শীতলতাও আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে নিয়েছে। চলে গেছে বহু মুহূর্ত সময়ের সাথে চিরতরে। এক চোখ ফাটা হাহাকার শুধু রয়ে গেছে শূন্যতাকে সম্বল করে। জীবনের শেষ ১.৫/২ টি বছর হঠাৎই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছিল ঘটে চলা ঘটনার আকস্মিকতায়।
২০০৯ শেষ হতে হতে অনেক কিছুই ততক্ষনে বাস্তবের সামনে দাঁড়িয়ে গেছিল, আর তার মধ্যে এটাও ছিল স্বপ্নের মসৃণ গাঁথার দিন শেষ। হঠাৎই বন্ধু হারানোর যন্ত্রনা ভেতরটা খাঁখাঁ করছিল, কিন্তু কাউকে কিছু বলার ছিল না। কিছু কাছের বন্ধুরা শুধু জানত, সহানুভূতি বোধ করত, কিন্তু কারো সাথেই সেই জায়গাটা শেয়ার করার উপায় ছিল না যেটা শুধু আমাকেই নিভৃত্য অন্তরালে নিয়ে পুড়তে হত।
শেষ সেদিনটার পরে কয়েক মাস কেটে গেছে। ধীরে ধীরে জীবনের ছন্দে আবার ফিরতে চেষ্টা করছি, কিন্তু গতি বলতে সেরম কিছু ছিল না। নিত্যদিনের নিয়ম মত অফিস যেতাম, কাজ করতাম, সন্ধ্যের ভিড় ঠেলে ঘরে ফিরতাম। আলাদা করে নিজের কোন অস্তিত্ব খুঁজে পেতাম না। কিছুটা জড় পদার্থের মতই হয়ে গেছিল, সবই ছিল, চলছিলও।
এরমধ্যে আমার হাতে উঠে এসেছে আমার দ্বিতীয় ক্যামেরা D90। প্রথমটি আমারই এক কলিগ্কে দিয়ে আমার দ্বিতীয় ক্যামেরা হাতে তুলে নিয়েছিলাম। তা ছবি যে বেশ কিছু তুলতাম সেরকম না। বন্ধুদের অনুষ্ঠান, টুকরো-টাকরা শহরের আশপাশ – এসবই। ক্যামেরা আমি ভালোবাসতাম, তবে সেভাবে সেটাকে নিয়ে বেশী ভাবিনি, আর ৫ জনের মতই। দিন কেটে যাচ্ছিল।
সেভাবে কখনই বেড়ানো পার্টি বা ভ্রমন পিপাসুও ছিলাম না। মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান হিসাবে অনেকের মতো আমারও ঘোরা বেশ একটা জোটে নি। কচ্চিৎ-কদাচিৎ বন্ধুদের সাথে ট্যুর, বা পরিবারের সাথে রেয়ার ট্যুর ছাড়া সেরম কোন স্বাদ ছিল না, তাই এই ব্যাপারটা নিয়ে কোন রোমাঞ্চও ছিল না। তবে কোলকাতার বাইরে বেরতে পারলে খুবই আনন্দিত হতাম।
বয়ে গেছে আরও কয়েকটি মাস। জীবনের নিয়মিত ছন্দও আবার সময়ের নিয়মে ফিরে এসেছে। তবে সেই শূন্য জায়গাটা রয়েই গেছে, কোন কিছুতে পূর্ণ করতে পারেনি। কাজকর্মের মধ্যে নিজেকে অনেকটা হারিয়ে দিয়েছি, জীবনের ফেলে আসা পরাজয় মেনেও নিয়েছি।
অগষ্টের শুরু, বর্ষা সবে ঢুকেছে কোলকাতায়। দাবদাহের মরসুমের শেষে মাঝে মধ্যে মৌসুমী বায়ুর ব্যাস্ত আনাগোনা।
আমাদের যাওয়াটাও ঠিক হল এই ভেবে যে ওখানেও নিশ্চই বর্ষা পাব। বন্ধুরা কতটা বলেছিল বা নিজে কতটা প্রস্তুত ছিলাম জানি না কিন্তু রাজী হয়েছিলাম; আর একটা চেঞ্জস্ এর দরকারও ছিল। যাওয়া, থাকা সবকিছু বন্দোবস্ত ওরাই করেছিল, আমি তো শুধু যাত্রী ছিলাম। যাই হোক, অগষ্টের কোন একটা দিনে আমরা চার বন্ধু বেনারসগামী ট্রেনে চেপে বসলাম, গন্তব্য বেনারস বা বারাণসী।
অনেকের বারাণসী বলতে একটা ফ্যাসিনেস্ন কাজ করে; নস্টালজিক অলিগলি, ফোটোগ্রাফি.. তবে আমার সেরম কিছু ছিল না। আমারতো বারাণসী বলতে সেরম কোন আইডিয়াও ছিল না, যদিও ক্যামেরা ঘাড়ে করে চেপে বসেছিলাম (ট্রেনে)। তবে আমার যেটা ফ্যান্টাসি ছিল, গঙ্গাবক্ষে বর্ষা নামবে আর আমরা বসে থাকব। যদিও সেটা পৌঁছতে পৌঁছতে ধূলোয় মিশে গেছিল।
বিহার পেরিয়ে উত্তরপ্রদেশে ঢুকতে ঢুকতে বুঝে গেছিলাম গরমের দাবদাহে পুড়ছে উত্তরপ্রদেশ। চলন্ত ট্রেনের মধ্যে বসেই বাইরের লু অনুভব করছিলাম আমরা। বাইরের চলমান পথের দিকে যেটুকু দৃষ্টি যায়, মানুষজন দেখছিলাম কোনরকমে মুখ হাত কাপড় দিয়ে ঢেকে নিজেদের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ছুটছে। খাঁখাঁ করা গরমের মধ্যে যখন হোটেলে পৌঁছলাম আমরাও বাধ্য হলাম আমাদের পূর্বনির্ধারিত ঘরের পরিবর্তে অতিরিক্ত দিয়ে AC ঘর বুক করতে।
এর পরের দুটো দিন কোথা দিয়ে কেটে গেল নিমেষের মধ্যে। প্রচুর ঘুরলাম, ছবি তুললাম, গরমেতে পুড়লাম, কিন্তু সর্বোপরি এক স্বাধীনতাও অনুভব করলাম।


ফেরার দিনে চোখের পলকে এগিয়ে আসাতে একটু কষ্টও হচ্ছিল যখন আমরা চার বন্ধু মিলে DSLR-এ টাইমার দিয়ে গ্রুপ ফোটো তোলার আয়োজন করছিলাম আমাদের হোটেলের রুমে, বারাণসীর শেষ স্মৃতি হিসাবে। মন চাইছিল আরো একটু থাকতে, আরো দুটো দিন, হোক না সে গরম বা ঘিঞ্জি এলাকা।

শেষের দিকেতে আবার আমার ক্যামেরাটা বিগড়েছিল; তাই একটু মন খারাপও হয়ে ছিল, যাই হোক, কলকাতায় এসে যখন পৌঁছলাম স্টেশন চত্বরে চোখ গিয়ে পড়ল কাছাকাছি থাকা একটা ম্যাগাজিন স্টলে। স্টেশনের ম্যাগাজিন স্টলেতে গিয়ে থাক্থাক্ করে রাখা বই, ঝোলানো ম্যাগাজিনের দিকে চোখ বোলানোর মজাই আলাদা। তবে এবারে আমার চোখ গিয়ে আটকে গেল এক সদ্য প্রকাশিত The Travelers ম্যাগাজিনের দিকে। কোনও এক স্পেশাল সংখ্যা বাজেট ট্রাভেলের ওপর, ভারতে। এক অদম্য আগ্রহে কিনে নিলাম। পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে কত সুন্দর ছবি, কত জায়গা! চক্চকে পাতা – বন্ধুদের নিয়ে এসে দেখানোর তর সইছিল না।
সেই বইটা, কোথাও কিছু একটা পাল্টানোর সূত্রাপাত ছিল, যার শুরু হয়েছিল বারাণসীর যাত্রা থেকে। আর তারপরে একটা গোটা বছরেরই সাবস্ক্রিপশ্ন নিয়ে নি (ট্রাভেলার ম্যাগাজিনের)। বেরবার ইচ্ছাটা যেন তখন থেকেই চেপে বসেছিল, সুযোগ পেলেই মন বাইরের টানে ছুটত। নিজেকে চেনা, মানুষকে চেনা – ভ্রমনই ছিল যা সেই জায়গাগুলো খুলে ধরতে পারত। আর সেই কথাতেই আছে না, কাউকে জানতে হলে তার সাথে একবার ট্রাভেল করতে হয়। বছর পাশে থেকেও মানুষকে চেনা যায় না, কিন্তু একবার ট্রাভেল করলে তার সাথে অনেক কিছু চেনা যায় জানা যায়। সেই কেউটা কোথাও আমিই ছিলাম!
আর এরপরে অনেক জায়গায় ভ্রমন হয়ে গেছে, কেটে গেছে বহুটা বছর; ফেলে আসা সেই দিন – কি পেলাম কি হারালাম এসব নিয়ে আর ভাবিনি, ভাবার মানসিকতাও আসেনি। একটা অনলাইন ম্যাগাজিনও শুরু করে দিয়েছি। দেশ-বিদেশের বহু জানা-অজানা ব্যাক্তির ছবি সংগৃহীত করে রমরমিয়ে চললও কয়েকটা বছর – World Photographers’ Summit. তবে এখন আর সময়ের অভাবে সেভাবে দৃষ্টি দিয়ে উঠতে না পারায় সে ওয়েবসাইট আর নেই। তবে ফেসবুকের পেজটা রয়ে গেছে!
তো এই হল আমার এক শেষের আর নতুন করে কিছু শুর করার, কিছু পাওয়ার কাহিনী। Pretty regular.. eh? আর ইররেগুলার কেই বা চায়।