ডুয়ার্সের গরুমারা ন্যাশনাল পার্কের নিকটবর্তী হিমালয়ের পাদদেশের ছোট্ট প্রাকৃতিক শোভাবেষ্টিত অঞ্চল মুর্তি। মুর্তির নামকরন এখানকার মুর্তি নদীর নামানুসারে। এখানকার সৌন্দর্য্য এখানের ঘন জঙ্গল, বন্য প্রানী, এখানের চক্চকে্ নদীর জল এবং সরলমনা মানুষের জন্যই হয়ে আছে। মুর্তির পরিষ্কার হাওয়া, দূষনমুক্ত পরিবেশ, অনাবিল নিস্তব্ধতা যেকোন ভ্রমন-পিপাসু মানুষকেই কাছে টানবে। শহরের জ্যামজটের থেকে দূর কিছুদিনের অগোচর জীবনযাপন, যেকোন মানুষকেই স্বস্তির নিশ্বাস দেবে।
সময়টা ছিল জানুয়ারীর শুরু, ২০০৮ সাল; আমি আর আমার বন্ধু কাঞ্চনকন্যা মেলে কলকাতা থেকে এসে পৌঁছলাম দিনের প্রথম ভাগেই। ছোট্ট পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন জনরোষহীন নিউ মাল জংশন স্টেশনে। স্টেশনের বাইরে গুটিকয় গাড়ি অপেক্ষা করছিল ভাড়ার জন্যে। তারি মধ্যে একজনার সাথে দামদস্তুর করে আমরা রওয়ানা হয়ে পড়লাম আমাদের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে – মুর্তি W.B.F.D.C. বাংলো।

সংকীর্ণ রাস্তা ধরে, শহরতলীর কিঞ্চিত ভিরভাড় পেছনে ফেলে, মসৃন পথ ধরে যখন আমরা ওয়েস্ট বেঙ্গল ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের বাংলোয় এসে পৌঁছলাম তখন চারিদিকের রূপরাশি, শান্ত প্রকৃতির নিস্তব্ধতা আর কলহমুক্ত পরিবেশ দেখে আমাদের আর আলহা্দ ধরছিল না। তার ওপর এত শান্ত খোলা বাংলোর চৌহদ্দি আমাদের মুগ্ধ করছিল। বাংলোর ঘেরার মধ্যে অসংখ্য গাছগাছালি বৃক্ষরাশি, যাদেরকে আমরা চিনিও না, কিন্তু তাদের উপস্থিতি এবং ছায়া, অসংখ্য নাম না জানা পাখির ডাক, এবং সুন্দর জায়গাবহুল গোছানো রুম আমাদের সত্যি মন নাচিয়ে গিয়েছিল।

যেটা সবচেয়ে আমাদের মন নাচিয়ে গিয়েছিল সেটা হচ্ছে বাংলোর পেছন দিকে খোলা বাঁধানো নদীর ঘাট। বাগান চত্তরের মধ্যে দিয়ে একটু সোজা হাঁটলেই বাংলোর পাঁচিল খুলে সোজা নদীবক্ষ। কয়েক ধাপের বাঁধানো সিঁড়ি নেমে গেছে নদীবক্ষে। চারিদিকে গাছের ঘন শোভা, মিষ্টি খোলা তরতাজা হাওয়া আর দূর নদীবক্ষে পড়া চড়। আকাশের মুক্ত নিলীমা আর তরতাজা দিনের আলো, সত্যি এজিনিষের জন্যই তো এতদূর ছুটে আসা। আমরা মহা আনন্দিত ছিলাম, বারবার ঘর বাগান আর নদীর বাঁধানো পাড় করছিলাম, যেন মন কিছুতেই রাশ মানছিল না।

আমি কিছুক্ষনের মধ্যেই আমার ক্যামেরা বক্ষে বেঁধে বেরিয়ে পড়লাম চারিদিকের একটু জরিপ করার জন্যে। বন্ধুকে বিছানায় শুয়ে পা দুলিয়ে দুলিয়ে আয়েস করতে রেখে। চারিদিকের একটু জরিপ না করলে আর হচ্ছিল না, কোথায় কত কি দেখার আছে এখানে! বাগানের মধ্যে দিয়ে সরু পথ ধরে চলতে শুরু করলাম। বাংলোর জায়গাটি এতই বড় এবং অসংখ্য বৃক্ষরাশিতে ঢাকা, এখানের পরিচারকেরা খুব যত্নের সাথে রক্ষনাবেক্ষনও করছে এগুলির।

মূল রাস্তা থেকে একটু নেমে গেলেই বাংলোর মেন্ গেট। দিনের আলো গায়ে মেখে আমি উঠে এলাম মূল রাস্তার উপরে। সোজা রাস্তা দূর গাছগাছালির বাঁকে কোথাও অদৃশ্য হয়ে গেছে।

রাস্তার দুপাশে শুধুই সবুজের মেলা। ঘন সবুজে বিছানো ঘাস, আর মাঝে মাঝে বৃহৎকার নানাবিধ বৃক্ষ। পড়ে থাকা রাস্তা নিজের সংকীর্নতাকে নিয়ে শুধু চলে গেছে তাদেরই মাঝে দিয়ে।

ইতিউতি তাকাতে তাকাতে আমি মূল রাস্তা ধরে এগিয়ে যেতে লাগলাম। নদীর পাড়ে কিঞ্চিত ব্যাস্ততা চোখে পড়ল; এক পুরুষ আর মহিলা কিছু কাজ করে যাচ্ছিলেন নদীর স্রোতের মধ্যে নেমে, যদিও আমি ঠাহর করতে পারলাম না কি কাজ। দিনের আলোয় ওঁনারা ব্যাস্ত ছিলেন নিজেদের কাজে।

আর একটু এগোতেই একটি সেতু চোখে পড়ল। নদীর এপার আর ওপারকে বেঁধেছে। চোখে পড়ল সেতুর রেলিংয়ে শুকতে দেয়া পাটের রাশি। আমার কাছে মুহূর্তে স্পষ্ট হয়ে গেলে ওই পুরুষ আর মহিলা কোন কাজে ব্যাস্ত ছিলেন নদীবক্ষে। ওঁনারা নদীর জলে পাট ভিজিয়ে কাচছিলেন, এবং ওঁনাদের পাশে জড় করা ছিলে পাটেরই বাঁধুনি।
সেতুর ওপর চোখে পড়ল আরো কিছু ব্যাস্ততা। এক দঙ্গল শৈশব তৈরী হচ্ছিল তাদের কোন কাজের রূপ দেয়ার জন্য। একটু দাঁড়াতেই আমি বুঝলাম এ মাছ ধরার পালা।

ছেলেপুলের দল সেতুর পাদদেশে অনায়াসে নেমে মাছ ধরার তোড়জোড় শুরু করল। কিছু কৌতুহলী চাহনি শুধু ওপর থেকেই নিরীক্ষন করতে লাগল। দঙ্গলের সম্বল শুধুমাত্র একটি পতপতে ছিপ আর অনেকগুলি হাত।
সেতুর নিচে এর পাদদেশে অসংখ্য ফাটলের মধ্যে খরস্রোতা নদীর জল ক্রমাগত ধাক্কা মেরে চলেছে। পাড়ের কাছে কাচের মত স্বচ্ছ জল সেখানে অনায়াসেই দেখা যায় কোন মাছ জলের ধাক্কায় কোন ফাটলের মধ্যে ঢুকে পড়লে। একবার ঢুকে পড়লে সেখান থেকে বেরনার রাস্তাও কম থাকে। ছেলেপুলেরা সেইরকম একটি আটকে পড়া মাছের দিকে দৃষ্টী নিবদ্ধ করে ছিল। কেঁচোর চার দেয়া makeshift ছিপ আর দুই আগ্রাসী বন্ধুর ঝাঁপিয়ে পড়ে মাছের গতিদ্বার আটকানো, এই ছিল তাদের হাতিয়ার।

সেতুর কাছে নদী খুবই খরস্রোতা। ক্রমাগত ধাক্কায় টুকরো টুকরো অংশ খুলে নিয়ে যাচ্ছে সেতুর নিচ থেকে। আবার এই নদীই আর একটু দূরে গিয়ে বাংলোর সামনে অনেক শান্ত, দেখলে মনে হয় পার হয়ে যাওয়া যায় নদীর এপার থেকে ওপ্রান্তে।

পরিশ্রমের ফসল ধরা দিল একটি মাছের রূপে। আমিও ওদেরকে পেছনে ফেলে বাড়ির পথ ধরলাম।

রোদ মাথার ওপরে এবং পেটে খিদে, বাংলোর শান্ত সুন্দর পরিবেশের মধ্যে আবার ফিরে এলাম। কিছু করার নেই কিন্তু আবিষ্কারের জিনিষ অনেক আছে।

বাংলোয় ফিরে এসে সামান্য আহারাদির পরে পেছনের নদী ঘাটে চান। তরতাজা রোদের নিচে ঠাণ্ডা জল, কুলুকুলু বয়ে যাওয়া নদীর জলে দুজনে গা ভিজিয়ে বসে রইলাম। জল এখানে কম কিন্তু তাও স্রোত আছে। কিছুটা এগোলে ভয়ও লাগে যে বয়ে নিয়ে যাবে, কারন নিচে পাথর বড়ই পিচ্ছিল। কোনরকমে ঘাটের সামনের দিকেতে দুজনে বুক পর্য্যন্ত ভিজিয়ে বসে রইলাম। প্রথমাবস্থায় যেরকম মনে হয়েছিল যে এখানে নদী পেরিয়ে সহজেই অপরপ্রান্তে পৌঁছে যাওয়া যায়, বুঝলাম তা দূর অস্ত। দুজনে তারি মধ্যে বসে তারিয়ে তারিয়ে প্রকৃতি এবং স্নান উপভোগ করলাম।
বিকালের জন্য একটি গাড়ি ঠিক করা হল যে আমাদের নিকটবর্তী ডুয়ার্সের জঙ্গলে নিয়ে যাবে।

বিকালে কোন এক রিসার্ভ ফরেস্টের গেটের সামনে এসে উপস্থিত হলাম আমরা। বৃষ্টি-বাদলের জন্যে আর বিকালের সময় তাই আমাদের বলা হল কিছুটাই ঢুকতে পারবেন, সামনের ওয়াচ্ টাওয়ার দিয়ে ঘুরে আসুন, গরুর গাড়ির বন্দোবস্ত আছে ভেতরে নিয়ে যাবার জন্যে আর সন্ধ্যেবেলায় আদিবাসী নৃত্য। আমাদের ড্রাইভার গেটের ভিতরের কাউন্টারে গিয়ে টিকিটের বন্দোবস্ত করল।

সরু রাস্তা চা’বাগানের বুক চিরে ভিতরে চলে গেছে, আমরাও হাঁটা লাগালাম, আমাদের নিয়ে চলল একজন কর্মচারী ছেলে। সরু রাস্তার দুপাশে বিস্তৃত চা’বাগান। পিঠে চা’এর ঝোড়া নিয়ে মহিলারা চা তুলে যাচ্ছে। আমরা হাঁটতে হাঁটতে উপস্থিত হলাম একটা উঁচু জায়গায় যেখানে একটি বড় হাতিও বাঁধা ছিল।

এরইমধ্যে আকাশে মেঘ করতে শুরু করেছিল, দিনের আলোও অনেকটা কমে গেছিল। অন্যান্য কিছু যাত্রীর সাথে একটি মোষের (গরু নয়) গাড়িতে সওয়ার হয়ে বসলাম আমরা, পেছনে আর একটি গাড়ি আমাদের অনুসরন করল। গাড়ি ক্রমশঃ চওড়া রাস্তা ছেড়ে আরো সংকীর্ন মেঠো পথ ধরল। আকাশ যেন আরো কালো করে এল এর মধ্যে।

যখন ওয়াচ্ টাওয়ারের কাছাকাছি এসে পৌঁছলাম ততক্ষনে বৃষ্টি নেমে পড়েছে। টিপটিপ ফোঁটা বড়বড় আকারে রূপ নিতে নিতেই আমরা ছুটলাম অদূরবর্তী ওয়াচ্টাওয়ারের উদ্দেশ্যে। মাথায় কোনরকমে এটা ওটা চাপিয়ে ক্যামেরা বাঁচাতে বাঁচাতে। কাদা-জলে মাখামাখি পায়ে যখন টাওয়ারে এসে উপস্থিত হলাম তখন বৃষ্টি জোরে নেমে এসেছে। সরু ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে আমরা দোতলায় উঠে এলাম, অনেক পযর্টক আগেই অপেক্ষা করছিলেন সেখানে। মনসুনের বৃষ্টির ধারায় সবুজ জঙ্গল নদী প্লাবিত হতে দেখলাম আমরা।
সন্ধ্যের অন্ধকারে আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে আমরা কখন যেন কোন গ্রামে পৌঁছে গেলাম। পথিমধ্যে অন্ধকার আর সংকীর্নতার জন্য মাঝে মাঝেই যেন দিশেহারার মত লাগছিল। এখানের হাতীর রাস্তা পেরনার কুখ্যাত গল্প শুনতে শুনতে আমরা একসময়ে কোথাও পৌঁছে গেলাম। চারিদিকে এক হাত উঁচু ইট দিয়ে ঘেরা এক সভাস্থল, টিমটমে একটি কেরোসিনের লম্প – তাতে আঁধার তো কিছু কাটে না কিন্তু চাপরাশ অন্ধকার যেন আরো চেপে বসে। সভাস্থলের সামনে একটু ফাঁকা জায়গা, এরপরে আড়াআড়ি করে পাতা লম্বা লম্বা কাঠের বেঞ্চ, বসার উচ্চতায়। টিমটিমে লম্পের আলোতেই আমাদের হাতে ধরাধরি করে চা-বিস্কুট পরিবেশন করা হল, চোখে চাপ দিয়েও যেন পাশের অন্ধকার কাটছিল না।
আরো কিছু পরে একদল লাজুক আদিবাসী নৃত্যশিল্পীর দল লাইন দিয়ে সামনের ফাঁকা জায়গায় প্রবেশ করল। সাথে দু’জন বাদক। ঘিরে থাকা চাপা অন্ধকারের মধ্যে একমাত্র লম্পটাকে ঘিরে তাদের নাচ শুরু করল।

একমাত্র লম্পের আলো অপরিমিত হওয়ায় দাঁড়িয়ে থাকা কোন একটি গাড়ির হেডলাইট জালিয়ে দেয়া হয়েছিল কিছুক্ষনের জন্য। হুনহুন করা সুর আর দেয়ালে প্রসারিত লিকপিকে ছায়ার ঘুরে ঘুরে নাচ, আর মাদলের দ্রিম দ্রিম শব্দ, সব মিলিয়ে আমরা হারিয়ে গেছিলাম কোথাও কিছুক্ষনের জন্য।

রাতে আবার জঙ্গলের মধ্যেকার সংকীর্ন অন্ধকার পথ ধরে ঘরে ফেরা। খাবার চাপাই ছিল আমাদের জন্যে ড্রইংরুমের ডাইনিং টেবিলে। রাতে একটি শান্ত ঘুম।
সকালে অন্যান্যবারের মত এবারেও ঘাড়ে ক্যামেরা ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। যেকোন জায়গায় ঘুরতে গিয়ে সকালের সময়টা আমায় খুব টানে। যেকোন জায়গার সকাল একটা আলাদা মাহাত্য রাখে। এদিনের সকালে অপেক্ষা করছিল একমুঠো বিচ্ছুর দল।

ক্রমশঃ..
Finished and waiting fir the next..Outstanding travel story.
LikeLiked by 1 person