সকালে ঘুমটা যে একটা ভালো ভাঙল তা বলব না, তবে বেটার বোধ করছিলাম আগের রাতের থেকে। আমার প্রতিবেশীকে দেখলাম না, বোধহয় বেরিয়ে পড়েছে সকাল সকাল। ঘরের একমাত্র জানলা প্ল্যাস্টিক দিয়ে ঢাকা থাকায় বাইরেটা ঠিক বুঝলাম না, তবে রাতের সেই ঝড়ের দাপট আর নেই, শান্ত এবং ঠান্ডা।
পেটের টান থাকায় আমি প্রাতঃকর্মের জন্য বেরিয়ে এলাম। লম্বা করিডরটা নিস্তব্ধ, পরিত্যক্ত। লোকজন এখনও সেভাবে ওঠেনি, অথবা যে যার খোলের মধ্যে এখনও আস্তানা নিয়ে আছে। করিডরের ঘষা প্ল্যাস্টিকের বারান্দা দিয়ে আলো এসে পড়ছে, করিডরটাকে যেন আরো মলিন আর একাকী করে তুলেছে। শমীকরা এখনও ওঠেনি। বাথরুমটা ছিল ঢোকার রাস্তার দিকে, আমি নিজেকে কোনরকমে গুটিয়ে এগিয়ে চললাম তার দিকে।
বাথরুমে ঢুকতেই একটা চাপা বিস্ময়, ভিতী আর আতঙ্কে যেন ফেটে পড়লাম। ভেতর দিয়ে সব যেন উঠে এল গলার কাছে। কোনরকমে দেয়াল ধরে নিজেকে সামলালাম। আতঙ্ক আর ঘেন্নায় গা রি্ রি্ করে উঠল। তার বর্ণনা দিতেও আমি এখন ভিতী বোধ করছি। শুধু এটুকু বলতে পারি, পরের ৫ মিনিট অসহ্য অবর্ণণীয় কষ্টের মধ্যে কাটিয়েছি, কাটিয়েছি কারন আর কোন রাস্তা ছিল না আমার কাছে অথবা জানা ছিল না। কোনরকমে নিজের কাজটুকু সেরে বেরিয়ে এলাম। এখানে জল অনেকটা নিচ থেকে আনতে হয়, তাই বাথরুমে তা বিন্দুমাত্রও ছিল না, শুধু কিছু টয়লেট পেপার ছাড়া। ঘৃণা করবেন না – আমি কিছু সুরাহা করে আসতে পারলাম না কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আরও একরাশ ঘৃণা ছেড়ে এলাম।
ট্রাভেলর টিপ্সঃ পোর্টারের সাথে কথা বলে বেটার অ্যাকোমডেশনের ব্যাবস্থা করুন। হাট একান্তই কিছু না পেলে তখন কনসিডার করুন।
রুমে ফিরে আর করারও কিছু ছিল না, তাই বাইরে বেরোনার সিদ্ধান্তই নিলাম। প্রয়োজনীয় কাপড়জামা গায়ে চড়িয়ে কিছুক্ষনের মধ্যে বাইরে বেরিয়ে এলাম। ক্রমশঃ আরো ধাতস্ত বোধ করছিলাম।
হাট্-এর কিচে্ন-কাম্-ডাইনিং’টা হাট্-এ ঢোকার মুখের সামনেই পড়ে। বাইরে তখনো কুয়াশা কাটেনি, দূরে পাহাড়ের রাশিও সাদা কুয়াশায় ঢেকে আছে, ভিসিবিলিটি completely zero. পিটার আগেই সেখানে উপস্থিত ছিল। আমি কিচে্নে ঢুকে পরিচ্-এর অর্ডার করলাম। আগের দিনের খাওয়ার প্রবলেমের থেকে আজকে একটু সতর্কই ছিলাম, কোন রকম ভারী মশলাদার খাবারে আর আমি একদমই যেতে চাইছিলাম না। সে তুলনায় পরিচ্ যব আর ইয়াকের দুধ দিয়ে তৈরি, হাল্কা এবং উঁচু পরিবেশের পক্ষে আদর্শনীয়।
কিচেনে বড় খোলা জানলার পাশে একটা মননসই জায়গা নিয়ে বসলাম। পাশের পার্টিশন দেয়া ঘরে রান্নার ব্যাবস্থা। বাইরের কুয়াশা এখনও কাটেনি। আমার বসে পরিচে্র অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোন কাজ ছিল না। আমার রুমমেট সকাল সকালই ফালুটের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে।
.
বসে বসে অপেক্ষা করছি, বাইরে কিছু চীৎকার শুনে জানলার দিকে মুখ ঘোরালাম। কিছু লোক হাত দিয়ে কিছু যেন দেখাবার চেষ্টা করছে। পিটারও এই সময় উঠে এসেছে জানলার কাছে চীৎকার শুনে। দিক নির্ধারিত হাতের দিকে লক্ষ্য করে চোখ প্রসারিত করতেই দেখলাম দূরবর্তী পাহাড়ের রাশির গা থেকে কুয়াশা সরে গেছে। খুলে গেছে পাহাড়ের গা। মেলে ধরেছে নিজেদেরকে শীতঘুমের মধ্যে থেকে উঠে। দিনের সূর্যের আলো প্রসারিত হয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের রাশির ঢল বেয়ে অসংখ্য পাহাড়ি শাখার মধ্যে।
পিটারের দুচোখ খুশীতে ভরে গেল মুখ হাঁ হয়ে গেলে। যে কটা ট্যুরিস্ট কিচেনে অপেক্ষা করছিল, সবাই ছুটল। আমি ‘পরে আসছি’ বলে ছুটে রুমে ফিরলাম। নিজের গিয়ারে সুসজ্জিত হয়ে ছুটে বেরিয়ে গেলাম অদূরে একটা বাঁকের দিকে। এখানটা দিয়ে পাহাড়ের রাশি চোখের সামনে খুলে যায়। ইতিমধ্যেই জায়গাটা ভরে গেছে খুশীর হাওয়ায়। কোথা থেকে অগুনতি মানুষের ভিড় উঠে এসেছে ওখানে, কিচিমিচিতে ভরে গেছে মানুষের। সবাই খুশী, উচ্ছল। ঠান্ডার চাদর, জ্যাকেটে মুড়ে অসংখ্য দেশী, বিদেশী ট্যুরিস্ট।
আমি স্বতঃস্ফূর্ত জনতার মধ্যে দিয়ে নিজের রাস্তা করে একটা উঁচু জায়গা উঠে গেলাম আর নিজের জায়গা পাকা করে ফেললাম। ট্রাইপডটা এতদিন পরে কাজেতে লাগাতে পারায় খুশী আমি। উঁচু-নিচু ঢালু জায়গায় ট্রাইপড আটকানো একটা অসুবিধে অবশ্যই। তবে অ্যাডজাস্টবল কলকব্জার দরুন সেটাকেও করে ফেললাম কিছুক্ষনের মধ্যে।

ভোরের শান্ত শীতল রোদ তখন ছুঁয়ে যাচ্ছে, আমাদের হয়ে দূরের পাহাড়শৃঙ্গ, অসংখ্য জমে থাকা কুয়াশার কণার মধ্যে দিয়ে, সরিয়ে দিয়ে ভেজা মেঘের রাশি, উন্মুক্ত করে শিঙ্গালীলা পাহাড়ের রাশি নিজের শান্ত শীতল কিন্তু তীক্ষ্ণ রোদের কাছে, ছুঁয়ে আরো দূরে মাউন্ট এভারেস্টের চূড়াকে। ক্রমশঃ ক্রমশঃ এই অত্যাশ্চর্য্য শৃঙ্গরাশি যা একমাত্র এখানেই দেখা যায়, খুলে উঠল আমাদের অসংখ্য সম্মোহিত, চোখের সামনে। আপ্লুত দর্শকেরা চোখ কান ঘ্রান ভরে যেন শুষে নিতে লাগল প্রকৃতির সেই আশর্য্য সৌন্দর্য্যকে।
শিঙ্গালীলা শৃঙ্গরাশি এক নিজের মত অভিনব দৃশ্যাবলী এখানকার, যা অন্য কোথাও আর দেখা যায় না। একইসাথে এত শৃঙ্গের লয়, সত্যি যা দুর্লভ। কুম্ভকর্ন রেঞ্জ, কাঞ্চনজঙ্ঘা, সিম্ভো এবং পান্ডিম রেঞ্জ মিলে এমন এক অবয়বের সৃষ্টি করেছে, যা এখানকার লোকাল নামে ‘The Sleeping Buddha‘ বলে পরিচিত। মনে হয় যেন কেউ শুয়ে আছে শিঙ্গালীলার দিগন্ত বিস্তৃত কিনারে। আরো আরো উত্তরে সুদৃঢ় এভারেস্টের চূড়া সূর্য্যের আলো পড়ে ঠিকরে উঠছে। তবে সুদূর উত্তরে অবস্থিত হওয়ায় তা মাঝে মধ্যেই ঢেকে যাচ্ছে ঘন মেঘের আড়ালে আবার দৃশ্যমান হচ্ছে, আর এখান থেকে বেশ ক্ষুদ্রও। ওইপাশটা অবশ্যই নেপাল। এই শিঙ্গালীলা রাশিই বর্ডারের কাজ করে নেপাল এবং ভারতের মধ্যে।
চোখ ভরলেও মন ভরছিল না। তাই বাক্সবন্দী করার জন্য অসংখ্য ক্যামেরা চকা্চক্ করেই যাচ্ছিল। কেউই যেন ক্ষান্ত হতে পারছিল না ছবি তোলা থেকে। আর যখন হাঁপিয়ে পড়ছিল তখন মন্ত্রমূগ্ধের মত চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখে যাচ্ছিল। যতক্ষন না পর্য্যন্ত আবার এনার্জি কানায় কানায় ভরে যাচ্ছিল, এবং আবার চকা্চক্ ক্লিক ক্লিক।
আমিও অগুনতি ছবি তুললাম। ট্রাইপডটা থাকায় প্যানোরামার জন্যে ছবি নিতেও সুবিধা হচ্ছিল। এরমধ্যে শমীকরাও এসে গেছে। বহুক্ষন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে এই ঐকান্তিক দৃশ্য আহরন করলাম।
বেশ কিছুক্ষন পরেও লোকের জটলা খুব একটা কমল না। লোকেরা এখনও মন্ত্রমুগ্ধের মত চেয়ে আছে। কিছু কিছু লোক এরমধ্যে আবার যে যার জায়গায় ফিরতে শুরু করল। আমাদেরও আজ নিচের দিকে নামার আছে, আমি নিজের জিনিষপত্র গুটিয়ে লোকের পাশ কাটিয়ে ধীর ধীরে আমাদের কিচে্নের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। দর্শকদের ভিড় সমস্ত ওদিকে চলে যাওয়ায় কিচে্ন মোটামুটি ফাঁকাই ছিল। জানলার পাশে একটা যুতসই বেঞ্চ দেখে আবার বসে পড়লাম। বড় খোলা জানলা দিয়ে সামনের ভিড় এবং পাহাড়ের অংশরাশি পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল।
গরম গরম পরিচে্ তখন মুখ ভরেছি কয়েকবার, এক সাদা চামড়া মুখ বড় জানলার ওপাশ থেকে আমার দিকে এগিয়ে এল, “Can I, can I borrow your tripod?” শীতের জড়তায় কথাগুলো বুঝতে একটু অসুবিধা হলেও ট্রাইপড শব্দটা শুনে বুঝতে পারলাম। সম্মতির সাথে প্যাক করে রাখা ট্রাইপডটা এগিয়ে দিতে কিছুক্ষনের মধ্যে ফিরে আসার সম্মতি শুনিয়ে লালমুখো ছুটতে ছুটতে চলে গেল ভিড়ের উদ্দেশ্যে ট্রাইপড নিয়ে। যাক, আরও কারো যে কাজে লাগল এটা বেশ ভালোই লাগল। আমি আবার পরিচে্ মনোনিবেশ করলাম। পরিচ্ খাবারটি খুবই অমুখরোচক, un-ইন্টারেস্টিং এবং একঘেয়ে খেতে, অনেকটা সাবুর মতন। কিন্তু আমার ওইসময়ে ওই একটাই পথ্য যা খেয়ে আমাকে অতটা রাস্তা আবার জার্নিও করার আছে। তাই ইচ্ছা না থাকলেও যতটা সম্ভব খেয়ে পেট ভরাতে লাগলাম।
শমীক, অয়নও পরিচে্র অর্ডার করেছিল। কিন্তু ওরা কিছুটাও মুখে তুলতে পারল না। ব্রেকফাস্ট স্কিপ করল ওরা, পথিমধ্যে অন্য কোথাও কোন কিছু খেয়ে নেবার চিন্তা করে – কিন্তু সেটা যে কতবড় ভুল ছিল পরবর্তী সময়ে গিয়ে সেটা বুঝেছিল।
আমরা আরো বেশ কিছুক্ষন বাদে আমাদের বেরোবার প্রস্তুতি করতে লাগলাম। লালমুখোও এরমধ্যে আমার ট্রাইপড দিয়ে গেছে। বাইরে তখনও কিছু উৎসাহীর জটলা রয়ে গেছিল যখন আমরা ট্রেকার্স হাটের রাস্তা ছেড়ে নিচের বনাঞ্চলে নেমে এলাম। ঝলমলে রোদ আমাদের চলার পথের সঙ্গী আজ। চক্চকে আকাশ, মিঠে মৃদু হাওয়া, সবুজ বনাঞ্চল, আর সতেজ নিশ্বাস – আর কি চাই, এভাবে তো আমি বহুদূর হেঁটে যেতে পারি।


তবে মনের মধ্যে একটা রিগ্রেট থেকেই গেল – ফালুট আর হয়ে উঠল না এবারে। অয়ন-শমীকেরা মানসিকভাবে কাহিল, আমারও পায়ের শতাধিক মাস্ল যেন ক্লান্ত চিৎকার করছে – একটু রেস্ট দাও আমাদের। কোথাও আমিও মানসিকভাবে একটু একা হয়ে পড়েছিলাম, ফালুটের ইচ্ছাও তাই ধীরে ধীরে ত্যাগ করতে হল। পেইনফুল, কিন্তু টিমের সাথে থাকাটাই যুক্তিযুক্ত মনে হল এবং একে অপরের দরকার আছে আমাদের।
পিঠে আবার সেই বোঝা চাপিয়ে বেরিয়ে পড়া পাহাড়ি ঢালানের উদ্দেশ্যে। আগের দিনের মত আর ভুল করিনি আমি – এবারে আরো হালকা জামাকাপড় গায়ে চড়িয়েছি। রোদও আছে, তাই ঠান্ডা লাগারও এসময়ে কোন ভয় নেই। আমরা সান্দাকফুর অপেক্ষাকৃত চওড়া পথ ছেড়ে পাহাড়ি ঢালের এক সংকৃর্ন পথ ধরে নেমে এলাম, এক ঘন জঙ্গলের মধ্যে। বুঝলাম, এ হচ্ছে up-close সিঙ্গালীলা অরন্যভূমি।

পাখ-পাখালির অজস্র কিচমিচের মধ্যে দিয়ে আমরা এগিয়ে যেতে লাগলাম, দিনের সূর্য্যের আলো গাছেদের শাখা-প্রশাখার মধ্যে উঁকি মেরে আমাদের দেখে যাচ্ছিল। সংকৃর্ন মেঠো-পাথুরে পথে আমরা চার যাত্রী, হেঁটে চলেছি, আর দুদিকে ঘন জঙ্গলের রাশি যেন আমাদের জন্য সতেজ দিনের সূচনা দিয়ে আহবান করে যাচ্ছে।
কোথা দিয়ে যেন শরীরের কষ্টগুলোও ম্লান হয়ে গেছিল – সেভাবে আর অনুভব করছিলাম না। আমি আর পিটার আগে আগে এগিয়ে চলেছিলাম, পেছনে অয়ন আর শমীক। সকলেই চোখ খুলে এই খোলা জঙ্গলের সৌন্দর্য্য আহরন করছিলাম, ওটা কোন পাখির ডাক, ওটা কি, ছোটখাটো ঠাট্টা-তামাশা নিজেদের মধ্যে, এভাবেই আমরা নিজেদের মধ্যে হেঁটে যাচ্ছিলাম। পিটার আমাদের এখানকার ইতিহাস, জঙ্গলের বৃতান্ত সব বুঝিয়ে যাচ্ছিল, আমরা চারমূর্তি জঙ্গলের রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছি আর মাঝে মধ্যে কিছু আদিবাসী মানুষকেও অতিক্রম করতে করতে।
রাস্তা ক্রমশঃ সুখকর থেকে দুর্গম হতে শুরু করল। যত জঙ্গলের মধ্যে ঢুকতে লাগলাম ওবোড়-খাবোড়, উঁচু-নিচু পাহাড়ী রাস্তার মধ্যে দিয়ে আমাদের যেতে হতে লাগল। সেগুলো ঠিক রাস্তা নয়, পথ চলে পথ হওয়ার মতো, সংকীর্ণ, ভাঙা। নিচের দিকেতে নামার রাস্তাগুলো ক্রমাগতই মাটি পাথর ভেঙে ওপর থেকে নিচে নেমে আসার মতো। সেখানে ঠিকঠাক পা ফেললে ঠিক আছে, কিন্তু উল্টোপাল্টা পড়লে পা মচকানো বা হুমড়ি খেয়ে পড়বার মত আশঙ্কা আছে। আমার গাম্বাট ট্রেকিংয়ের মত জুতোটা আমাকে কিন্তু তখনো পর্য্যন্ত ভালো সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছিল। অনেক উঁচু-নিচু ওবোড়-খাবোড় রাস্তাতেও কখনও ফাঁকি দিয়ে যায়নি। স্প্যালেনেডের ভারত শু থেকে ২০০০/- টাকায় কেনা জুতো। ভরসা করতে সাহস পাচ্ছিলাম। কিন্তু অয়নটা অতটা লাকি ছিল না, কোন দুর্বল মুহূর্তে পা মচকে ফেলেছিল বেচারা আরো পরে গিয়ে।
কখনও আমরা জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছিলাম, আবার কখনও পাহাড়ের গায়ে উঠে আসছিলাম। চকচকে দিন, শান্ত বনভূমি, খোলা পাহাড়ের ঢাল। পথ চলতে চলতে আরো দু-একটা পোর্টারদের দল আমাদের সাথে যুক্ত হয়ে গেল। ওরাও নিচে আসছে অন্যান্য যাত্রীদের মালপত্র নিয়ে। আমরা ১০/১৫ মিনিট অন্তর বিশ্রাম নিতে শুরু করলাম। পাহাড়ের ক্রমাগত খাড়াই আর ঢালান আমাদের ক্লান্ত করতে শুরু করেছিল। পায়ের মাস্লগুলো টানটান হয়ে ককিয়ে যাচ্ছিল, আর পিটার খালি বলে যাচ্ছিল চলতে থাকুন, চলতে থাকুন, যত বসবেন ততই টেনে ধরবে, বসতে ইচ্ছা করবে। আমরাও ক্রমাগত নিজেদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ দিয়ে যেতে লাগলাম শরীরকে।
বেলা বাড়ার সাথে সাথে সবাই মোটামুটি কাহিল হতে শুরু করলাম। অবশ্যই পোর্টাররা আমাদের মত কাহিল ছিল না, আমরা মোটামুটি দুলকি চালেই এগিয়ে চলেছিলাম, শমীক আর অয়নও বেশ হালকা চালে গল্প করতে করতে এটা ওটা দেখতে দেখতে আসছিল। আজ ওদের আগের দিনের জার্নির থেকে অনেক বেটার মনে হচ্ছিল। কিন্তু পেটে টান পড়েছিল, ব্রেকফাস্ট স্কিপ করেছিল ওরা। আমাদের এর-ওর পকেটে কিছু চক্লেট- চুইংগাম নিয়ে তখনকার মত চালিয়ে যেতে হল, কিন্তু ক্লান্তি ছাপ ফেলতে শুরু করেছিল।
সকাল গড়িয়ে দুপুর নেমে এল। ১৪ কি.মি. – আমাদের নিকটবর্তী গ্রাম এবং আমাদের সেদিনের গন্তব্য গুরদুম‘এর দূরত্ব পিটারের মতে। কিন্তু এই রাস্তার যে শেষ কোথায় বুঝতে পারছিলাম না। কিছু বাদাম, চক্লেট আর আধ্-বোতল কোক্ ইতিমধ্যেই শেষ হয়ে গেছে, জলও হয়ত আর কিছুক্ষন পরে শেষ হয়ে যাবে। শমীককে আরো বেশী কাহিল লাগছিল, ব্রেকফাস্ট স্কিপ করায় যে কি বড় ভুল করেছে সেটা নিজেই বুঝতে পারছিল। শমীক ছাড়া অয়ন এবং আমি দুজনের কাঁধেই নিজ নিজ বোঝা। হঠাৎ চীৎকার শুনে পিছন ফিরে তাকাতে দেখি অয়ন মাটিতে বসে পড়েছে, দুহাতে একটা পা ধরে। কোন একটা ভাঙা ঢাল দিয়ে নামার সময় পা ফেলা বা ব্যাগের ভারে ভারসাম্য রাখতে পারেনি, আর পা ধরে বসে পড়েছে। পায়ের গোড়ালি মচকেছে। আমাদের কাছে সেসময় কিছু ছিল না, বা আমাদের থেমে যাবার মত অবস্থাও ছিল না। পিটাররা সামনের দিকে এগিয়ে গেছিল, আমি আর শমীক কোন রকমে শ্রূশষা করে ওকে দাঁড় করালাম, মচকানো পায়ে ভর ফেলতে ভয় পাচ্ছিল, কোনরকমে শমীকের কাঁধে ভর করে ধীরে ধীরে তাও করার সাহস জোগাড় করল এবং তিনজনে আবার আমরা ধীরপায়ে রওনা দিলাম।


দুপুরের পর থেকে দিনের আলো নিস্প্রভ হয়ে গেছিল। সেই চকচকে রোদও আর ছিল না, কোথাও কোথাও যেন বড়ই মলিন লাগছিল জঙ্গলের মধ্যে আরো সেই আলোকে। আমি দাঁতে দাঁত চিপে এগিয়ে যাচ্ছিলাম পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে। কাঁধে পিঠের ভার যেন আরো কামড়ে বসছিল। যেখানেই রেস্ট নিচ্ছিলাম কাঁধ থেকে ভার নামিয়ে একটু নিশ্বাস নিতে চেষ্টা করছিলাম। ব্যাগটা সত্যিই আরো হালকা হতেই পারত। ক্ষনিক বিশ্রামের শেষে আর যেন সেই ব্যাগ তোলার ইচ্ছা হচ্ছিল না; আর আমার ব্যাগ তোলার কেউ ছিলও না।

পায়ের মাস্লগুলো বহুক্ষন আগেই কামড়ে ধরেছিল। হাঁটুর নিচ থেকে ক্রমশঃই এক নতুন শিহরন অনুভব করতে শুরু করলাম, এক ধরনের কাঁপন। যত নিচ দিকে নামতে শুরু করেছি পাহাড়ি রাস্তা ভেঙে হাঁটুর নিচ দিকে কাঁপনও যেন বাড়তে শুর করেছিল তার সাথে। শরীরের ওপরের অংশের ভার আর নিম্নাভিমুখী গতির চাপ সবটাই বুঝতে পারছিলাম পায়ের ওপরেই পড়ছে – বিশেষ করে হাঁটুর এবং নিচুর অংশে। চারিদিকে কুয়াশাও ঢাকতে শুরু করেছে, এরমধ্যে ধীরে ধীরে আমরা বসতির চিহ্ন দেখতে শুরু করলাম। পাহাড়ের গায়ে ছোট ছোট কুঠি, নিচে আরো নিচে শস্য ক্ষেত, দূরে উপত্যকার রেখা যেন আরো রহস্যময় কুয়াশার সাথে দিন শেষের ঘন্টা বাজতে।


এরমধ্যে আমি জীবনের সবচেয়ে নতুন উপলদ্ধি নিতে শুরু করেছি, হাঁটুর নিচর দিকে কাঁপন তখন এক চরম পর্য্যায়ে পৌঁছে গেছে, এরম কাঁপুনি আমার জ্ঞ্যানত কখনও উপলদ্ধি করিনি। থরথর কাঁপুনি নিচ দিকে যেন এখুনি পা ভেঙে আমি বসে পড়ব কোথাও। এর বাইরে শরীরের যে অন্য কোন ক্লান্তি, শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি সেরম কিছু নেই, শুধু থরথর করে হাঁটুর নিচ দিকে কাঁপন ছাড়া যা সারা শরীরেই এক কাঁপন দিয়ে যাচ্ছে মাঝে মধ্যে। ক্রমাগত নিচু ভাঙা পথে নামতে নামতে হাঁটুর সহ্যসীম কোথাও অতিক্রান্ত হয়েছিল। একটা সময় এরমও এল যে মনে হল আমি সত্যি এবার হাঁটু ভেঙে বসে পড়ব, আর চলতে পারব না, পিটারকে বা কাউকে ডাকতে হবে। সংকীর্ণ পাহাড়ি ঢালের কোথাও কোথাও সরু কাঠের বেঞ মত করা ছিল। আমি সেরম পেলেই মালপত্র ফেলে তার ওপর বসে পড়ছিলাম, আর আমার পিঠের দিকটা পাহাড়ি ঢাল কোথাও নেমে গেছে কুয়াশার আড়ালে, পাহাড়ের ওপর দিকটাও সাদা হয়ে আছে।

পিটার এরমধ্যে একটু উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। আমরা অনেক্ষন অপেক্ষা করেও শমীক, অয়নের কোন দেখা পাই নি। যোগাযোগ করার কোন মাধ্যমও নেই অপেক্ষা করা ছাড়া। দুজনেই চিন্তিত ছিলাম জঙ্গলের রাস্তায় কোথাও অন্য দিকে না চলে যায়, যদিও একটাই ভরসা ছিল যে একটা দূরত্বের পর থেকে শুধু নিচে নামাই। আমরা আরো কিছুক্ষন দুজনে অপেক্ষা করে পিটার সাজেস্ট করল এবার আমাদের নামা উচিত, গন্তব্য যখন খুব বেশী দূর আর নয়। সবুজ শস্যক্ষেত তখন অনেক কাছে, সরু আলপাড় রাস্তা পাহাড়ের গায়ে দিয়ে বেয়ে আমরা এগিয়ে চললাম, গাঢ় লাল রঙের কাঠের গুঁড়ির বেড়া রাস্তার পাশে পাশে পোঁতা আছে, সবুজ শস্যক্ষেতের ওপর দিয়ে বয়ে চলা হাওয়া দেখে বেশ ভালোই লাগছিল। আমি আর পিটার যখন গুরদুমের বিশ্রামস্থলে পৌঁছালাম তখন ঘড়িতে বিকাল ৪ টা; যদিও কুয়াশার জন্যে মনে হচ্ছিল আরো বেশী।

এক নজরে দেখেই ভালো লেগে গেল; কতটা সুন্দর হয়ত বর্ণনাও করতে পারব না। পাহাড়ের সউচ্চতায় বেশ কিছুটা অংশ কেটে এই ট্রেকার্স হাট; ঘন গাছগাছালিতে ঢাকা সুন্দর বেশ কিছু কাঠের-সিমেন্টের কুটির নিয়ে এই ট্রেকার্স হাট’টা। সুদূরে পাহাড়ের ঢাল নেমে চলে গেছে কোন অদূরে বর্ণনা নিয়েছে সবুজ কুয়াশায় মোড়া উপত্যকার। ট্রেকার্স হাটের গা ঘেঁসে পাহাড়ি ঢাল নেমে গেছে ঘন জঙ্গলের মধ্যে। চারিদিকে ঘিরে আছে গভীর সবুজ বন, আর অসংখ্য নাম না জানা পাখির রব। অদ্ভুত ঠাণ্ডা পরিবেশ এটা একটা। যেকোন মানুষকে গভীর প্রশান্তি দিতে পারে এই জায়গা। হাটের কুটীরগুলোর সামনে একটু ফাঁকা জায়গা মতন, পাহাড়ি ঢালের দিকে লোহার বেড়ার এপাশে কাঠের বেঞ্চ পাতা বসার জন্যে। একটু উঁচু জায়গা থেকে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে এই ট্রেকার্স হাট। নিচে নামতেই একটা বৌদ্ধ স্তুপা, তার মধ্যে একটা ছোট্ট বুদ্ধ। নিচে মাটিতে স্থলপদ্ম ফোটানো।

আমি নেমে এসে একটা বেঞ্চির সামনে আমার মালপত্রা ফেলে বসে পড়লাম, কিছুক্ষনের মধ্যেই একটা গভীর প্রশান্তি অনুভব করলাম। চারিদিকের শান্ত পরিবেশ, নরম ঠান্ডা হাওয়া, পোর্টাসদের মৃদুমন্দ হাসির আওয়াজ, আর পাখির ডাক, এক গভীর প্রশান্তির অনুভব করিয়ে যাচ্ছিল আমাকে। বুঝতে পারছিলাম আমার যাত্রা আজকের মত শেষ, বিশ্রাম..




কতক্ষন পড়ে ছিলাম ওরম করে মনে নেই, এর মধ্যে পিটার আমার সঙ্গীদের খুঁজতে বেরিয়ে গেছে। কিছুক্ষন ওর ডাকাডাকির আওয়াজও বোধহয় পেয়েছিলাম। কিছুক্ষন পরে ওরা তিনজনে ফিরে এল, পিটার অয়ন আর সমীককে নিয়ে ফিরে এল। দুজনকে দেখে খুব একটা ক্লান্ত মনে হল না! যতটা আমি হয়ত আশা করেছিলাম। দুজনে দিব্যি ছবি তুলতে তুলতে খোশ মেজাজে নেমে এল ওপর থেকে। ভালো লাগল ওরাও ফিরে আসতে।
পরে শুনলাম ওরা নিজেদের হারিয়ে ফেলেছিল জঙ্গলের মধ্যে। ঘন্টাভর খুঁজেছেও আমাদের – আমাকে আর পিটারকে, এবং তারপর কিসব অদ্ভুত আচরন করতেও নাকি শুরু করে দিয়েছিল অয়ন, সমীকও বুঝতে পারছিল না কি করবে। এরিমধ্যে ওরা পিটারের গলার আওয়াজ পেয়েছিল যখন পিটার ওদেরকে খুঁজতে গিয়েছিল, ঘন কুয়াশার মধ্যে থেকে। তারপরে পিটারের জোর শিষ লক্ষ্য করে ওরা এগিয়ে গিয়ে তিনজনে দেখা পায়।
আমরা তিনজনেই যথেষ্ট ক্ষুধার্ত ছিলাম। আমাদের দেয়া কুটীরের মধ্যে নিজেদের মালপত্রা ছেড়ে ৫টার সময় আমরা খেতে বসে গেলাম। অয়ন আর সমীক আগে থেকেই অনেক ক্ষুধার্ত ছিল, আমরা সবাই মিলে মহা আনন্দে উষ্ণ কাঠের কিচেন-কাম-ডাইনিং’য়ের মধ্যে বসে আলু পরোটা আর ফ্রুটির সাথে আমাদের টিফিন সারলাম। শুনলাম এই আলু পরোটা এখানের নাকি খুবই বিখ্যাত, বহু দূর দূর থেকে লোক আসে এখানে এই পরোটা খেতে, তবে আমাদের যেন পশ্ হোটেলের পিজা্র থেকেও বড়ই ভালো লাগল, হয়তবা কিছুটা প্রচুর খিদে থাকার জন্যে, যাইহোক আমরা পরম তৃপ্তিতে খেলাম। খুব ভালো লাগল গরম গরম আলু পরোটা খেতে, গরম গরম তৈরি করে দিচ্ছিল আর আমরা ভোজনার রস নিচ্ছিলাম। বাইরে তখন মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছে। মৃদু স্বরে ইংরাজী গান বেজে যাচ্ছিল কোথাও।
খাওয়ার পরেও বৃষ্টি ঝরে যাচ্ছিল বাইরে, আমরা কেউ কেউ ডাইনিং কুটীরের বাইরের সরু বারান্দায় বেরিয়ে এলাম, অঝোর ধারায় ঝরে যাচ্ছিল প্রকৃতি, জঙ্গলের গাছগুলো নুয়ে নুয়ে যাচ্ছিল ঝড়ের দাপটে, সবুজতায় ধুয়ে যাচ্ছিল গাছের পাতাগুলো। বৃষ্টির প্রবল ছাঁটে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকাও দায় হয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু ঘরে আটকে থাকতেও মন চাইছিল না। আরো কিছু পরে প্রকৃতি শান্ত হয়ে এল, বৃষ্টি থেমে গেল। দিনের আলো তখনও বাকি ছিল। ধুয়ে যাওয়া দিন শেষের আলোতে কটেজটাকে আরো সুন্দর লাগছিল। কাঠের দেয়ালের গভীর রংগুলো, চারিদিকে সাজিয়ে রাখা ফুলের টব্, সাজানো গোছানো বাগান, আমরা খুব তারিয়ে তারিয়ে অনুভব করতে লাগলাম, অসংখ্য ছবিও উঠল সবার ক্যামেরা থেকে।
আমি হাঁটতে হাঁটতে ভেজা চক্রাকার পথ ধরে অদূরের ক্ষেতের আল ধরে অনেকটা ঘুরে এলাম। সদ্য শেষ হওয়া বৃষ্টির পর প্রকৃতি যেন এখানে এক আলাদা রূপ মেলে ধরেছে। দূরে পাহাড়ি ধারে ক্ষেতের ফসলগুলোর মাথা যেন কে হাত বুলিয়ে চলে যাচ্ছে, হাওয়ার মুহূর্মুহূ ধারায় যেন এক অপরূপ ঢেউয়ের সৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যের দিকে আকাশ আরো পরিষ্কার হয়ে এল।



রাত্রে যখন আমাদের কুটীরের বাইরে বেরিয়ে ডাইনিং রুমের দিকে খেতে যাচ্ছিলাম, এক পলকের জন্যে আকাশের দিকে চেয়েছিলাম। স্তব্ধ হয়ে গেছিলাম। মুগ্ধ হয়ে গেছিলাম এতটাই যে আর ঘরে গিয়ে ক্যামেরা নিয়ে আসতে মন চাইনি। কিছু কিছু সৃতি মনেই রয়ে যাওয়া ভালো সেটা আমি সেদিনই বুঝেছিলাম। আকাশ ভর্তি অজস্রা তারা; এ এক মহাজাগতিক বিশ্ব ব্রম্ভান্ডের মধ্যিখানে যেন দাঁড়িয়ে থাকা; শতকোটি নক্ষত্র লোক যেন আমার চারিদিকে ঘিরে রয়েছে মাথার ওপরে। এরম জিনিষ আমি আগে কখনও দেখিনি। আমার শহরের আকাশ ধূসর, কখনও কখনও নক্ষাত্রাদি দেখা দিয়ে যায়, কিন্তু এরম স্বচ্ছ কৃষ্টালের মত অপরূপ নক্ষত্রলোক এর আগে আমি কখনও দেখিনি। মন্ত্রমুগ্ধের মত দাঁড়িয়ে রইলাম অন্ধকারে অনেক্ষন।
সেরাত্রে ঘুম হল ভালোই, শরীরও যথেষ্ট ক্লান্ত ছিল। পরবর্তী দিনের যাত্রার জন্যে এনার্জিরও দরকার ছিল। জঙ্গলের নিস্তব্ধতায় গুরদুমের দিনও কখন শেষ হয়ে গেল।
ক্রমশঃ..
সম্পূর্ণ সিরিজ – এখানে