05.21.2011
সকালে আমরা একটু দেরী করেই উঠলাম। আগের রাতে পিটারের সাথে কথা হয়ে গেছিল একটু দেরী করে বেরলেই হবে, ৯টা নাগাদ। তাই সকালে তাড়াতাড়ি ওঠার তাড়া ছিল না, আর এরম একটা জায়গায় ভোরবেলায় কম্বলমুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকার মত সুখ আর কিছু হ্য় না। এমনকি কম্বলের নিচে থেকে আমার ভোরবেলার ছবি তোলার ইচ্ছাও আমি নিজেই খারিজ করে দিলাম। খুব ভোরে একবার উঠতে হয়েছিল প্রকৃতির টানে, দিনের আলো তখনও ভালো করে ফোটেনি, ঠান্ডায় ঠকঠক করতে করতে দোতলার বাথরুমটা খুঁজে কোনরকমে সেরে আবার সটান এসে কম্বলের তলায় আশ্রয় নিয়েছি। শীতের ঠান্ডায় তক্তপোষও সুমধুর লাগে।
অয়ন আর আমি বেশ অনেক্ষন ঘুমিয়েছি। অন্যবারের মত এবারেও শমীক এসে আমাদের হুরদুর করে তুলে দিল। কোনরকমে নিজেদের প্রস্তুত করে আমরা নিচে নেমে লজে্ই ব্রেকফাস্ট সেরে নিলাম। চায়ের সাথে তিবেতান ব্রেড, বাটার আর ডিম সেদ্ধ; তিবেতান ব্রেডটা তবে খুব একটা ভালো লেগেছিল সেটা বলতে পারব না, তবে পেট ভরানোর দরকার ছিল মাত্র। এরপরে আমরা বেরিয়ে পড়ি আমাদের প্রথম দিনের ট্রেকে।
আমাদের প্রথম দিনের গন্তব্য কালাপোখরি (২৭.০৪উঃ ৮৮.০০পূঃ); মোটামুটি ১২-১৩ কি.মি. -এর হাঁটা পথ টুম্বলিন থেকে। যদিও সংখ্যাটা শুনতে নিতান্তই কম, কিন্তু পাহাড়ি রাস্তায় এক এক কিলোমিটারও যে কতটা বড় হয়ে যায় সেটা কেউ কেউ বুঝবেন।
সকালটা ছিল পরিষ্কার, সকালের সূর্য্যের আলো অন্যের চোখে ঠিকরে পড়ছিল। আমরা খুব আনন্দে মহা উদ্যমের সাথে আমাদের প্রথম দিনের যাত্রা শুরু করলাম। টুম্বলিনের সরু রাস্তা ধরে আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলতে লাগল আমাদের গাইড পিটার।




আমরা প্রত্যেকেই যে যার নিজের রাকস্যক নিয়ে চলেছি। আমি শুনেছিলাম এখানে বৃষ্টিও হয় যখন তখন, ঠান্ডাও ছিল, আমি তাই আমার মোটা জামা-কাপড়ের সাথে মোটা ভারি রেইন কোটের প্যান্টটাও পড়ে নিয়েছি। চলার পক্ষে যে এগুলো কতটা পরিপন্থী হয়ে উঠতে পারে সেটা আর একটু পরেই বুঝতে পারব। এরপরে আমার বুকের সামনে ঝোলা একটা ব্যাকপ্যাক যার মধ্যে আমার ক্যামেরা সংক্রান্ত জিনিষপত্র, মাথা গলিয়ে ঝোলানো ভারি DSLR, একটা জবরজং ব্যাপার হয়েই হাঁটতে শুরু করেছি। তবুও আমাদের মনে ছিল ফুর্তি, প্রথম ট্রেকের অভিযান, সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে যেন আমরা গ্রহন করে নিতে চাইছিলাম সবকিছু, আকাশ-বাতাসও যেন মেতেছিল আমাদের সঙ্গে আমাদেরকে রাস্তায় পেয়ে।



আমরা সরু রাস্তা বেয়ে ছোট ছোট জনবসতি, আলুর ক্ষেত পেছনে ফেলে এগিয়ে চলেছি। এই সময়ে রাস্তাও সেরম কঠিন লাগছিল না, সামান্যে চড়াই-উতরাই রাস্তা, আমরা সবাই গল্প করতে করতে চারিদিকের প্রকৃতির শোভা নিতে নিতে এগিয়ে যেতে লেগেছি। মনেতে ফুর্তি, আদ্রতাহীন ঠান্ডা রোদ চক্চকে্ পরিবেশ সবই আমাদের রাস্তার ওপর ছিল।


একটা সময়ে আমরা কোন একটা সংকীর্ন লোকালিটির মধ্যে এসে পড়লাম। একটু রেস্ট নেয়ার জন্য একটা দোকানে কিছুক্ষন বসলাম, কিছু সামান্য খাবার খেয়ে কোল্ড-ড্রিঙ্কস নিয়ে আবার যাত্রা শুরু করেছি। হাঁটতে আমার বেশ ভালো লাগছিল। নিজের কয়েকমাসের হাঁটার অভ্যেসকে মনে মনে ধন্যবাদ দিচ্ছি আর হাঁটছি, এটা হাঁটাকে অনেক সহজ করে দিচ্ছিল এই পাহাড়ি প্রদেশে।

সেই সংকীর্ন লোকালিটির পর থেকেই আমরা মূল পাহাড়ি রাস্তা ছেড়ে একটা আরো সংকীর্ন রাস্তার বাঁক ধরেছি, যেটাকে ঠিক রাস্তা বলা যায় না, পুরোটাই পাথুরে মাঠ-ঘাটের ওপর দিয়ে, পায়ে চলে পথ হওয়ার মত। ওটাকে আমাদের পিটার বলল যে আমরা এবার ট্রেকিংয়ের রুট ধরলাম। বুঝতে পারলাম যে এখানে মেন রাস্তা ছেড়ে আরো সংকীর্ন রাস্তা ধরে ট্রেকিং হয় (পাঠকরা মাফ করবেন আমার সেই সময়ের অতি অল্প জ্ঞানের জন্য ট্রেকের সম্বন্ধে, আমি শুধু সেই সময়কার চিন্তা গুলোই ব্যাক্ত করছি মাত্র)।

এরপর কোন একটা জায়গায় সিঙ্গালিলা চেকপোস্টে পিটার গিয়ে আমাদের এবং আমদের ক্যামেরার জন্য পাসে্র বন্দোবস্ত করল। সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আমাদের সামনে দিয়ে কয়েকটা ল্যান্ডরোভার বেরিয়ে গেল, কিছু মহা উৎসাহী রংচং-এ বাহারি পোষাকের কম বয়েসি ছেলে-মেয়েদের নিয়ে; ওদের দেখে মনে মনে দাঁত কিড়মিড় করতে লাগলাম, সালা্ (দুঃখিত পাঠকগন) আমাদের মত খেটে হেঁটে ওঠনা তাহলে বুঝবি, সব দাঁত বের করা ফুর্তি বেরিয়ে যাবে। কিরম মজাসে গাড়ি চড়ে সান্দাকফু পৌঁছে যাচ্ছে। অবোধ আমরা, পরবর্তীকালে মনে হয়েছিল কেন আমরা মরতে এখানে হাঁটতে এসেছি!!
gap
গিরিবাসের ঠিক আগে ঘটনাটা ঘটল। এই পর্যন্ত্য রাস্তা খুব একটা যন্ত্রনাদায়ক ছিল না, আমাদের মোটামুটি ছোটখাট চড়াই-উতরাই ক্রমাগত ফেস্ করতে হচ্ছিল, তার সাথে বিভিন্ন বাঁক, off-road terrain, পুরোপুরি যেগুলো শুধুমাত্রা হাঁটার জন্যই বলা যায় কোন গাড়ির জন্য নয়। এখন পর্যন্ত্য আমরা constant steep যাকে বলে সেরম রাস্তার সামনা করিনি। রাস্তা অনেক জায়গায় খারাপ থাকায় আমাদের চলার গতি তবে অনেকটা কমে গেছিল, পা ফেলতে হচ্ছিল সাবধানী ভাবে।
গিরিবাসের আগে রাস্তা হঠাৎ-ই দাঁত বের করা হয়ে গেল। রাস্তা এখানে পুরপুরি হাড়গোড় ভাঙ্গা সাইকেলের মতন। বড় বড় গর্ত, দাঁত বের করে থাকা নুড়ি পাথরের টুকরো, আর ছড়ানো বোল্ডারের মত পাথর। প্রথম ধাক্কাটা খেল শমীক-ই। পায়ের গোড়ালি মচকালো সঠিকভাবে কোথাও পা না ফেলার জন্যে।


এরপরেই আমাদের গতি অনেকটা স্লথ হয়ে গেল। শমীক আর সেভাবে হাঁটতে পারছিল না, গোড়ালি মচকানোর ব্যাথা তাকে কাবু করে দিচ্ছিল হাঁটা থেকে। ক্রমাগত পিছনে পড়ে যাচ্ছিল সে, আমরাও বুঝতে পারছিলাম না সেরম অবস্থায় আমরা কি করব যেখানে এখনো অনেকটা রাস্তা বাকি। শমীক তাও দাঁতে দাঁত চেপে আমাদের এগিয়ে যাবার পরামর্শ দিতে লাগল পেছনে আসার পতিশ্রুতি দিয়ে; কিন্তু কিছুক্ষনের মধ্যেই বোঝা গেল পিঠের ভারি ব্যাগটা নিয়ে এমতবস্থায় ওর পক্ষে আর হাঁটা সম্ভব নয়। শমীককে গাইড পিটারের সাথে একটা চুক্তি করতে হল, ঠিক হল একটা নির্দিষ্ট পারিশ্রমিকের ভিত্তিতে পিটার ওর রাকস্যাকটা বয়ে দেবে। এতে শমীকের বোঝাও কিছুটা হালকা হল আর আমরাও আশ্বস্ত হলাম যে এবার শমীক এবার কিছুটা ফ্রি হয়ে হাঁটতে পারবে। পিটারের নিজস্ব ছোট ব্যাকপ্যাক এবং আমার ট্রাইপড ব্যাগের সাথে এবার যুক্ত হল একটা রাকস্যাক। পাহাড়ি ছেলে, ক্রমাগত ওঠানামা করার অভিজ্ঞতা থাকার দরুন ও খুশী মনেই কাজটাকে নিয়ে নিল, আমরাও সবাই শ্বাস ফেলে আবার একটু হাঁটতে শুরু করলাম।
গিরিবাস আর্মি ক্যাম্পের সামনে কিছুক্ষন বিশ্রামের পর সেদিনের আসল চড়াইয়ের পথ ধরলাম আমরা। গিরিবাস থেকে আমাদের গন্তব্য কালাপোখরির দূরত্ব ৭ কি.মি.-র মত। কিছুক্ষন পরেই আমরা মেন রাস্তা যেটা কালাপোখরির দিকে উঠে গেছে সেটাতে উঠে এসেছি, এই রাস্তায় ল্যান্ডরোভারো যায়।
পাথুরে জর্জরিত রাস্তা এঁকেবেঁকে উঠে গেছে ওপরে। এর মধ্যে পাহাড়ি ওয়েদারও পাল্টে গেছে, মুখ ভার করে নিয়েছে আকাশ, রাস্তার একদিকে পাহাড়ের ঢাল আর জঙ্গলের মধ্যে বুঁদ হয়ে উঠছে কুয়াশা। পাহাড়ি ঢালের দিকে রাস্তা কিছুটা অন্তর করে করে বোল্ডার দিয়ে ফেন্স করা মতন আছে, আমরা মাঝে মধ্যেই বসে পড়ছি সেগুলোর ওপর বিশ্রামের জন্য। রাস্তার খাড়াই এবং দুর্দশা ক্রমশঃ চাপ ফেলে যাচ্ছিল আমাদের অ্যাভারেজ হার্ট আর দমের ওপর। মোটামুটি ৪৫ ডিগ্রীর খাড়াই কিছুক্ষনের মধ্যেই তানপুরা বাজাতে শুরু করে দিয়েছিল আমাদের পায়ের মাসল্ -এর ওপর। শমীক শীঘ্রই আরো কাতর হয়ে পড়ল পায়ের ব্যাথাতে। একটা ল্যান্ডরোভার আসাতে পিটার আবার তার ড্রাইভারের সাথে কথা বলে শমীককে সেই গাড়িতে তুলে দিল। ঠিক হল যে গাড়ি তাকে কালাপোখরিতে নাবিয়ে দেবে (আমাদের গন্তব্যস্থল) এবং সে আমাদের জন্য নির্দিষ্ট ট্রেকার্স হাটে অপেক্ষা করবে। শমীককে নিয়ে গাড়ি বেরিয়ে যাবার পর আবার আমরা চলতে শুরু করেছি।
মেঘলা পরিবেশ মুহুর্মুহু কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছিল, জঙ্গল ভাঙ্গাচোরা রাস্তাকে পেছনে ফেলে আমরা ধীর গতিতে এগিয়ে চলেছি। আমার পিঠের বোঝাটা ক্রমশঃ আমার দুই কাঁধেতে চেপে বসছিল, রাকস্যাকের ভার, সামনে ঝুলন্ত ব্যাকপ্যাক সামলানো আর তারপরে ক্যামেরার স্ট্রাপ ক্রমশঃ গলায় চেপে বসছিল। ভেতরে গরমটাও যেন হু হু করে বাড়ছিল, উইন্ডচিটার রেইন-কোটের প্যান্ট সবই যেন পরিপন্থী হয়ে উঠছিল আমার চলার পক্ষে। আমরা বারংবার হাঁটার মাঝখানে বিশ্রাম নিতে শুরু করেছি। যদিও পিটার আমাদের সাবধান করে যাচ্ছিল যত বসবেন ততই কষ্ট হবে, আপনারা উঠে ওই কষ্টের মধ্যেই চলতে শুরু করুন। কিন্তু আমরা বুঝছিলাম আমাদের পায়ের মাসল্গুলো তাতে সাড়া দিচ্ছিল না। সর্পিল রাস্তার এক মোড় থেকে অন্য মোড় পর্য্যন্ত পৌঁছতে চেষ্টা করছিলাম বিশ্রাম না নিয়ে, তারপর পৌঁছে এক-দেড় মিনিটের বিশ্রাম। মোটামুটি এভাবেই এগিয়ে চলেছি আমরা। পিটার দিব্যি ভারি রাকস্যাক নিয়ে নির্বিকার মুখে এগিয়ে চলেছে, অয়নের অবস্থাও খুব কাহিল লাগছে যত উঠছি আমরা।
এরমধ্যে হঠাৎই আকাশ কড় কড় করে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি এসে গেল। আমি কোনরকমে আমার ক্যামেরা একটা প্ল্যাস্টিক ব্যাগের মধ্যে পুরে মুখটা হাত দিয়ে এঁটে হাতের মধ্যে ঝুলিয়ে নিয়েছি। ব্যাকপ্যাকে ঢোকানোর মতন অবস্থা এখন নেই তাই হাতে ঝুলিয়েই বৃষ্টির মধ্যে হাঁটতে লেগেছি, কিন্তু চিন্তা হচ্ছে জল চুঁইয়ে না ভেতরে ঢুকে পড়ে। ঠান্ডা খোঁচা খোঁচা বৃষ্টি আমার চোখে-মুখে বিঁধছে, আমার উইন্ডচিটারের হুডটা মাথার সামনে টেনে নিয়ে কোনরকমে চোখমুখ বাঁচাতে চেষ্টা করছি। পিটার এবং আমাদের আগে পিছে চলা অন্যান্য পোর্টাররা তাদের একটা করে বড় সাইজের ক্লিয়ার প্লাস্টিক বার করে শরীরের ওপরের ভাগটা ঢেকে নিয়েছে। কলকলিয়ে জল পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আমাদের রাস্তাকে ধুয়েমুছে দিয়ে যাচ্ছিল। বেশ খানিক্ষন সেই বৃষ্টির মধ্যে ট্রেক করার পরে বৃষ্টিটা ধীরে ধীরে ধরে এল।
পথিমধ্যে আমাদের সাথে আর এক যাত্রীর পরিচয় হল। সেও ট্রেক করছিল একা এক পোর্টারের সাথে, তারও গন্তব্যস্থল কালাপোখরি তারপর সান্দাকফু হয়ে ফালুট। কোথাও একটা পাহাড়ি বস্তির ছোট খোলা দোকানে বিশ্রাম নিতে নিতে সে আমায় বলল এরম জায়গায় উঁচুতে ওঠার সময় যত পারো গরম জল খাও। সে চা’ই হোক, কফি’ই হোক, বা গরম জলই হোক। আমরা সেখানে চা খেয়ে আবার এগোতে লেগেছিলাম।
g
যখন কালাপোখরি সামনে গিয়ে পৌঁছলাম ততক্ষনে ধুয়ে গেছি আমরা; মনের জোর এবং শরীরের জোর দু’দিক দিয়েই। পা আর টেনে টেনে চলছিল না, পায়ের মাসল্গুলো যেন শক্ত টাইট হয়ে গেছিল, আর কিছুতেই একটুও এগোতে চাইছিল না। দিনের আলোও কমে এসেছিল যদিল বিকাল চারটে তখন। শমীক আমাদের জন্য কালাপোখরির সামনেই অপেক্ষা করছিল, পাশের সরু রাস্তার ছোট ক্রশিংটার পেছনে। এই সরু রাস্তায় ক্রশিংটা কি করছে বুঝলাম না, তবে বোঝার মত রুচিও তখন ছিল না আমার। আমরা তারপর সবাই ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে লাগলাম হোটেল সিঙ্গালিলার দিকে, এখানেই আমাদের রাতের ঠিকানা নির্ধারন হয়েছে।
রাস্তার দুপাশে দুটো অ্যাসবেস্টস ঢাকা ক্ষয়ে যাওয়া নিচু দেয়ালের বাড়ি নিয়ে এই হোটেল সিঙ্গালিলা। আমরা মেন বাড়ির মধ্যে যখন ঢুকলাম বুঝলাম ভেতরে পার্টিশন করেও অনেকগুলো রুম আছে। আমাদের সোজা ঢুকে একটা ঘর দেয়া হল। শমীকের জিনিষপত্র আগেই হাজির ছিল সেখানে। চার খাট বিশিষ্ট একটা রুম, আমাদের তিন জন্যের জন্য অবাধ জায়গা। আমি আর অয়ন আমাদের জিনিষপত্র কোনরকমে ঘরে ডাঁই করে বসে গেলাম কিছুক্ষন বিশ্রামের জন্য। কিছু পরে বাইরে বেরিয়ে এসে বুঝলাম রাস্তার অপরধারের বাড়িটি নিতান্তই রান্না এবং ডাইনিং ঘর হিসাবে ব্যাবহৃত হয়।
দিনের আলো কমে যাওয়া ধূসর আকাশের নিচে কালাপোখরির সামনে একটা বসার জায়গায় গিয়ে বসে রয়েছি আমি। ঠান্ডাটা বেশ জাঁকিয়ে বসতে লাগছিল আমার ওপর। জুবুথুবু হয়ে খানিক্ষন নিথর জলের পুকুরের সামনে বসে রইলাম, বলব না যে খুব একটা মনোময় ফীল হচ্ছিল বা নৈসর্গিক সৌন্দর্য্য ঘিরে ধরছিল, কালো জলের পুকুরটা নিথর হয়ে পড়েছিল, হয়ত মশার ডিমও জমে আছে জলের ওপর, কোন অংশেই আমার অনলাইনে দেখা কালাপোখরির সৌন্দর্য্যের সাথে মিল খুঁজে পাচ্ছিলাম না; তবে হ্যাঁ, চারিদিকের ভৌগোলিক বর্ণনার মিল ছিল। চারিদিকে আমাদের ঘন কুয়াশা বা মেঘ মতন ঢেকে ছিল তাই প্রকৃতির শোভা নেয়ার মতন অবস্থাও ছিল না। পায়ের কাফ্ মাসলে্র ব্যাথাটা টিকটিক করে যাচ্ছে।




আরো কিছুটা বাদেই কুয়াশা কেটে গিয়ে মেঘের ফাঁক দিয়ে ঠিকরে বেরিয়ে এল পড়ন্ত বিকালের রোদ। প্লাবিত করতে লাগল কালাপোখরির ছোট্ট উঁচু জায়গাটিকে। পাহাড়ের এই উচ্চতায় ওয়েদারের মুড বোঝাই ভার, এই মুখ গোমরা তো এই হাস্য প্লাবন।




পড়ন্ত সন্ধ্যের আগে আমরা মূল কুটিরের লাগোয়া জমিতে বিছিয়ে রাখা টবিল চেয়ারে বসে কালাপোখরির দিন শেষ হওয়া প্রকৃতির স্বাদ আস্বাদন করতে লাগলাম। লাইফ এখানে অনেক রিমোট, ব্যাস্ততাহীন, স্থির এবং সিম্পল্। আমাদের দুনিয়া থেকে সম্পূর্ন আলাদা, এই স্থিরতাই হয়ত আমাদের বারবার তাই টেনে আনে প্রকৃতির এই কোলে। পাহাড়ের ঢালে তখন মেঘের অদ্ভুত ঢেউয়ের খেলা শুরু হয়েছে, স্রোত যেখানে বাঁধ মানে না..


বিকালে পোর্টারদের ফুটবল খেলা দেখলাম, সন্ধ্যে ঘনিয়ে এল তার কিছু পরেই।


অন্ধকারের সাথে সাথে ঠান্ডাও যেন জাঁকিয়ে পড়তে লাগল। আমরা তিনজনে ট্রেকার্স হাটের কুঠুরির মধ্যে বসে বসে আমাদের পায়ের caressing করতে লাগলাম। কারো ব্যাগ থেকে একটা বাম্ বেরোতে সেটা মহা আনন্দে নিয়ে যে যার পায়ের থাই মাসলে্ ঘষতে লাগলাম, সেই সময়ে সেটাই একমাত্র উপায় বা রাস্তা ছিল আমাদের পায়ের ব্যাথা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে। শমীক কোন লোকাল মেডিসিন ট্রাই করেছিল পোর্টার্সদের কাছ থেকে নিয়ে, ওর পায়ের মচকানির জন্যে।
রাতে হোটেলের ডাইনিং কুঠুরিতে ডিনার করে আমরা অনেক্ষন বসে রইলাম। কিছু করারও ছিল না, বাইরেটা অন্ধকার কন্কনে ঠান্ডা। আমরা ঘরের উষ্ণতায় জুবুথুবু মেরে সবাই বসে রয়েছি। রান্না ঘরে জ্বলতে থাকা উনুনের তাপ আর ধোঁয়া ঘরের টিমটিমে আলোর মধ্যে এক অদ্ভুত মাদক পরিবেশ সৃষ্টি করছিল। আমরা সকলেই উনুনের গা ঘেঁষে বসে রইলাম, গল্প হচ্ছিল অনেক; রান্ন তৈরিতে ব্যাস্ত পাহাড়ি মেয়ের মিত হাসি, পোর্টার্সদের ঠাট্টা, জমিয়ে গল্প, ট্রেকার্স হাটের মালিকের খোলা গলায় গান, আর তৈরি হতে থাক ছাং (এক পাহাড়ি সুরা) – ঘরের আলো আঁধারি উষ্ণতাকে আরো জমিয়ে তুলছিল। আমরা বহুক্ষন বসে রইলাম, গান শুনতে শুনতে চোখের পাতাও কখন জড়িয়ে এসেছিল।
রাতে শুতে যাবার আগে ছোট্ট সিঁড়ি বেয়ে উঠে চিলেকোঠার পোর্টার্সদের ঘরেতে আমাদের মোবাইল ফোনগুলো দিয়ে এলাম চার্জ দেয়ার জন্য। রাতটা ছিল ঠকঠকে্ ঠান্ডা, মাল্টিপল কম্বল চাপিয়েও যেন ভেতরের কেঁপে ওঠা থামাতে পারছিলাম না। রাতে বিছানায় শুয়ে শমীক আর অয়নের বাজে ইয়ার্কি শুনতে শুনতে কখন চোখ লেগে গেছিল.. বাইরে তখন কোন এক অজানা রাক্ষসের ঠান্ডা হাত দুমরে পিষে দিচ্ছিল ছোট্ট পাহাড়ি জায়গাটাকে..
ক্রমশঃ..

সম্পূর্ণ সিরিজ – এখানে